মালেক ইকবাল।।

ক্যাম্পেইন বিষয় টা আমার সবসময়ই ভালো লাগে। চ্যালেঞ্জ নেওয়া শেখার অন্যতম একটা মাধ্যম। আমার মতে, জীবনে সবার একবারের জন্য হলেও ক্যাম্পে যাওয়া উচিত। আমাদের এবারের ক্যাম্প হিমালয়ে। পাহাড়ি লাইফ স্টাইল এর উপর আর্টিকেল কালেকশন করা। এসুযোগ টা অবশ্য এমনি এমনি আসে নি। এজন্য অনেক কাঠখড়ি পোহাতে হইছে। টানা ৬ মাস নিজদের গ্রুমিং করতে হয়েছে। জাতীয় প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করতে হয়েছে। রাজধানীর ইস্কাটনে বিএম ফাউন্ডেশনে জাতীয় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথম দিন ছিলো ওপেনিং সেরিমনি এবং বিভিন্ন ইভেন্ট। প্রোগ্রাম এর বিরতিতে একজন ফোন করে বললেন- আমার নানু খুব অসুস্থ। মৃত প্রায় অবস্থা। ইমারজেন্সি AB+ ব্লাড লাগবে। প্লিজ, আপনি কি কষ্ট করে আসবেন? 

দ্বিতীয় দিন ছিল আমাদের প্রোজেক্ট প্রেজেন্টেশন। চিন্তায় পড়ে গেলাম। কী করা যায়? স্যারদের সাথে বিষয়টা শেয়ার করলাম। তেমন কিছু বললেন না। শুধু বললেন- দেখো, তুমি যদি ফিজিক্যালি এন্ড মেনটালি ফিট থাকো তাহলে যাও। সমস্যা নাই। তবে মনে রেখো, আগামীকাল কিন্তু ফাইনাল প্রেজেন্টেশন। মনে মনে ভাবলাম- একজনের জীবনের চেয়ে কি আমার প্রেজেন্টেশন বড় হয়ে গেলো? কোনকিছু না ভেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলাম। আশি উর্ধ্ব বৃদ্ধ মহিলা ফ্লোরের উপর শুয়ে আছেন। যাই যাই অবস্থা। নিথর দেহ। দেখার মতো কেউ নাই। পাশে তার মেয়ের ঘরের নাতনি বসে অঝোরে কান্না করছে। ব্লাড দিয়ে আসার সময় উনার পাশে একটু বসলাম। ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলাম। তেমন কথা বলতে পারছে না। হাত দিয়ে ইশারায় বুঝালেন, দেওয়ার মত কিছু নাই। মাথাটা নিচু করতে বললেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কী যেন বিড়বিড় করে বললেন? আমার মনে খুব সাহস চলে আসলো। পরের দিন ফাইনাল প্রেজেন্টেশন শেষ। রেজাল্টের জন্য সবাই অপেক্ষা করছি। অবশেষে এলো সেই মহেন্দ্রক্ষণ। নিজেদের টিমের নাম শুনতেই চিৎকার দিয়ে উঠলাম। কিছুক্ষণ পর ওই বৃদ্ধ মহিলার মথা মনে পড়ে গেল। একটা সাফল্যের পিছনে অনেকের অনেকভাবে অবদান থাকে। 

সারাদিন পাহাড়ে ঘুরে ঘুড়ে একদম ক্লান্ত। শরীরটা আর পারছে না। তবুও সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম বিগ বাজার সিনেমা হলে এক থা টাইগার মুভি দেখব। সবাই রাজি হলেও আমার বন্ধু ওমর দ্বিমত পোষণ করে বলল-দোস্ত, প্লিজ, এই কাজটা করতে বলিস না। আমি জীবনে তিনটা কাজ কখনোই করি নাই। এক, হলে সিনেমা দেখি নাই। দুই, শেভ করি নাই আর তিন নম্বর হলো কখনও নামাজ মিস করি নাই। আসলেই এমন ভদ্র ছেলে এযুগে খুবই বিরল। নামাজের সময় হলে তার নামাজ মিস নাই। যেকোন উপায়ে নামাজ আদায় করতেই হবে। সেটা পাহাড়- সমুদ্র কিংবা বাসের মধ্যেই হোক। তাই আমরা ওকে আর চাপাচাপি করলাম না। আমি আর ওমর এক রুমেই ছিলাম। তাই হোটেলের রুমের চাবি দিয়ে আমরা মুভি দেখার উদ্দেশ্য রওনা হলাম। স্নো ড্রপস হোটেলে রাত ৮ টার দিকে ফিরলাম। হোটেলে প্রায় ২০ টার মতো রুম। পাহাড়ের কোলে অপরুপ হোটেল। আমি ৩০৩ নম্বর রুমে গিয়ে ওমরকে ডাকছি। আনুমানিক ৩৯ মিনিট ডাকাডাকি করলাম। কিন্তু ওমরের উঠার কোন বালাই নাই। ভয় পেয়ে স্যার ম্যামকে ডাকলাম। তাঁরাও এসে অনেকক্ষণ ডাকলেন। এরইমধ্যে প্রায় ৪০-৫০ জন মানুষ দরজার সামনে উপস্থিত হলো। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও কোন লাভ হলো না। কোন উপায় না দেখে আমি দরজায় জোড়ে জোড়ে ধাক্কা দিতে শুরু করলাম। ওর মোবাইল ফোনও অফ দেখাচ্ছে। আমাদের টিমের ১৩ জনই চলে আসছে। কেউ ওমরের খবর জানে না। সবার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ পর আবার ডাকা শুরু করলাম- এই ওমর উঠ, দোস্ত উঠ। আরও অনেকভাবে জাগানোর চেষ্টা করছি। এসময় হোটেলের ম্যানেজারসহ অনেকেই আসলেন। তারা কোনকিছুতেই আর ডাকতে দিচ্ছে না বলছে- এমন পরিবেশ হলে আমাদের সমস্যা আছে। আপনার আর চেচামেচি করবেন না। প্রয়োজন হলে থানায় কল করতে হবে। পুলিশ এসে যা করার করবে। যেভাবে দরজা ধাক্কা দিচ্ছেন। ভেঙে গেলে আমরা সমস্যায় পড়ে যাবো।

 স্যার বললেন- প্লিজ, আপনারা একটু হেল্প করুন। পুলিশ ডাকবেন না। আমরা ছাত্রশিক্ষকের একটা টিম শিক্ষা সম্মেলনে আসছি। পুলিশ আসলে অনেক ঝামেলা করবে।

একথা শুনে ম্যানেজার বললেন- প্লিজ, স্যার। বুঝতে চেষ্টা করুন। রুমের মধ্যে যদি কোন অঘটন ঘটে আবার আপনারা যদি দরজা ভাঙেন তাহলে পুলিশ আমাদের ঝামেলা করবে। 

-প্লিজ, আমাদের কিছু সময় দিন। না হলে পুলিশ কল করবেন। এই বলে আবার ডাকা শুরু করলাম। ডাকতে ডাকতে হাঁপিয়ে উঠেছি। আর পারছি না। এমন সময় বিহারের একজন বলছে- ওমর দাদা, ওমর দাদা, উঠুন। একবার উঠুন। এতবার ডাকছি। তবুও উঠছেন না। এটা কেমন কথা। এত্তবার ডাকলে মরা মানুষই তো সাড়া দেয়। আর আপনি কিছুই বলছেন না। দাদা উঠুন। উঠুন দাদা। 

এবার পাঞ্জাবের একজন মহর্ষি আসলেন। দরজায় ফুঁ দিয়ে ডাকা শুরু করলেন। ভড়াট গোলায় ডাকার শব্দে আশেপাশের হোটেলের অনেকেই আসলেন। কারও মুখে কোন কথা নাই। মহর্ষি বাবু দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বলছেন- এই ওমর উঠ, উঠ। এত্ত মানুষ একসাথে ডাকলে আমার পরম দাদুও শ্বশান থেকে উঠে আসতো। আর তোর কোন সাড়া শব্দ নেই। 

এই অবস্থা দেখে গতকাল রাতের কথা মনে পড়ে গেলো। রাত আড়াইটার দিকে ওমর আকস্মিক আমার শরীরের উপর লাফ দিয়ে চিৎকার করল। আমিও ঘুমের মধ্যে লাফিয়ে উঠলাম। জিজ্ঞেস করলাম- দোস্ত৷ কি হয়েছে?

ওমর ভয়ে কাপতে কাপতে বলল-দোস্ত, আমি ওয়াশ রুমে যেতেই দেখি একজন মেয়ে নববধুর সাজে বসে আছে। মাটি পর্যন্ত চুল। বিশাল বড় জিহব্বা বের করে আছে। জিহব্বা দিয়ে অনবরত রক্ত ঝরছে। দুই হাত ভরা চুড়ি। হাতে অদ্ভুত ডিজাইনের মেহেদী। অঝোরে কান্না করছে। দেখার পর আমি ভয়ে লাফ দিয়ে তোরে জোড়ায় ধরছি। 

-দোস্ত, ওমর। আমার মনে হয় তেমন কিছু না। সারাদিন অনেক পরিশ্রম করছোছ। খুব ক্লান্ত। শরীর দুর্বল হলে এমন মনে হতে পারে। সমস্যা নাই। ঘুমিয়ে যা। ঠিকমতো ঘুম হলে এমন মনে হবে না।

এই বলে দুজনই ঘুমানোর চেষ্টা করছি। হোটেলের রিসেপশনিস্ট এর কথা মেলানোর চেষ্টা করছি। প্রথমে এই রুম আমাদের ভাড়া দিতে চায় নি। আমরা বললাম- দাদা, দিন। সমস্যা নাই। আমরা ম্যানেজ করে নিব। এমন সময় আসছি। কোন হোটেলে কোন রুম ফাঁকা নেই। 

-দাদা, আমি বুচ্ছি। কিন্তু এই রুমে তো সমস্যা আছে। সবাই থাকতে পারে না।

-কেন, দাদা?

-আর বইলেন না, ভৌতিক ব্যাপার আছে। হানিমুনে এসে পাস্ট ইস্যু নিয়ে কথা কাটাকাটি করে এক নববধূ গলায় ফাঁসি নিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। তারপর থেকে এই রুমে যারাই উঠেছে তারাই ঝামেলায় পড়ছে। এই জন্য এই রুম ভাড়া দিতে চাই না। যেহেতু আপনাদের থাকার কোন ব্যবস্থা নেই, আপনিও জোর করছেন তাই দিলাম। দেখেনে, একটু সাবধানে থাইকেন। 

রিসেপশনিস্ট এর কথা ভাবতে ভাবতে ভয়ে হাল্কা ঘুমিয়ে পড়লাম। এরই মধ্যে ওমর আবার পাগলামি শুরু করছে। কান্না করতে করতে বলছে- দোস্ত, আমি এইবার শেষ। আমারে বাঁচা। 

-কেন, আবার কি হলো?

-তোর আশ্বাসে আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। হঠাৎ আমার কানের কাছে চুড়ির ঝনঝন শব্দ। চোখ মেলে দেখি ওই মেয়ে সাদা শাড়ি পড়ে আমার সামনে চুড়ি বাজাচ্ছে। সাদা শাড়িতে কাচা রক্ত এখনো লেগে আছে। সামনের দিকে চুল আর পিছনের দিকে মাথা। তার পা মাটি থেকে প্রায় দুই ফুট উচুতে। কাঠের বেলকুনির দিকে আমাকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে। অনিচ্ছা স্বত্তেও দরজা খুলে বেলকুনিতে গেলাম। চারিদিকে মেঘ আর কুয়াশা। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমি যেদিকে তাকাই ঠিক তার বিপরীত দিকে মেয়েটা চুড়ি বাজায়। কাঠের পাটাতনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ মেয়েটা আমার পা ধরে টেনে পাহাড়ের নিচে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আমি তোরে অনেক বার ডাকার চেষ্টা করেছি কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিল না। ঘেমে অস্থির হয়ে গেছি। কি করব ভেবে পাচ্ছি না? মনে হয় আজকেই আমার জীবন শেষ। মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়ে বুকে ফূঁ দিলাম। নিজেকে কিছুটা হাল্কা মনে হলো। মুহূর্তেই মেয়েটা আমার পা ছেড়ে ওই দূর আকাশে মেঘের মধ্যে মিলিয়ে গেলো। 

পাঞ্জাবি মহর্ষি বাবুর চেষ্টা ব্যর্থ হলে সবার মাঝে উৎকন্ঠা ছড়িয়ে পড়ল। ম্যানেজার থানায় জানালে কয়েক জন পুলিশ আসলেন। এরমধ্যে একজন মহিলা পুলিশ কর্মকর্তা। মনে হচ্ছে সদ্য নিয়োগ প্রাপ্ত। হেব্বি স্মার্ট আর চটপটে। কথায় আলাদা ধাচ আছে। অন্য সব পুলিশ দরজা ভাঙতে বললেও তিনি ভাঙার পক্ষে না। এমন সময় হোটেল বয়কে বড় একটা মই নিয়ে আসতে বললেন। মই দিয়ে ভ্যান্টিলেটর পর্যন্ত উঠার চেষ্টা করলাম। মই এর শেষ ধাপে উঠে ভ্যান্টিলেটর দিয়ে তাকাচ্ছি। বাম চোখ বন্ধ করে ডান চোখ দিয়ে ওমরকে খোঁজার চেষ্টা করছি। কিন্তু ছিদ্র ছোট হওয়ায় তা সম্ভব হচ্ছে না। এই রুমে ২ টা বেড ছিল। ভ্যান্টিলেটর এর বিপরীত পাশে ওমর ঘুমিয়েছিল। নিচে থেকে স্যার-ম্যাডাম সহ সবাই বারবার জিজ্ঞেস করছে- ওমর কি ভিতরে আছে?

-ম্যাম, আমি তো দেখতে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে নেই।

এটা শোনার পর সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ভেবে পাচ্ছে না কি করবে এখন? মহিলা পুলিশ আমার মই এর পাশে আরেকটা মই এ উঠে বলল- আপনাকে হেল্প করি। এই যে হাতুড়ি নিন। হাতুড়ি দিয়ে ভ্যান্টিলেটর এর ছিদ্র বড় করুন। এরপর ছিদ্র দিয়ে বোতলে করে বেডের উপর পানি ঢেলে দিন। গভীর নিদ্রায় গেলে জেগে উঠবে। 

হাতুড়ি দিয়ে ভ্যান্টিলেটর এর কয়েকটা আঘাত করতেই ইটের বালি আমার চোখে গেলো। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাতে পা প্রায় অবশ হয়ে গেছে। নি:শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। মাস্ক পড়ে থাকায় মুখও একদম ঘেমে গেছে। মাস্ক খুলতেই মহিলা পুলিশ বললেন- আরে! তুমি এখানে। ক্যাম্নে, কিভাবে?

-সরি, বুঝলাম না। 

-আরে, আমি আরতি শর্মা। 

আরতির সাথে উত্তর প্রদেশের লাক্ষ্ণোতে অবস্থিত সিটি মন্টেসরি স্কুলে প্রথম দেখা। একটা আন্তর্জাতিক স্টুডেন্ট কোয়ালিটি কম্পিটিশনে দুজনে কেইস স্ট্যাডি প্রেজেন্টেশনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। সে ছিল আমার অপোনেন্ট। ভালো বক্তা। যুক্তিখন্ডণে প্রখর। 

আরতি মাস্ক খুলে বলল- এইবার চিনতে পারছো?

-হ্যাঁ, কিন্তু তুমি এখানে পুলিশের বেশে!

-এ লেভেল কম্পলিট করেই পুলিশের চাকরি হলো। ও, একটা কথা, তোমাকে সরি বলা প্রয়োজন। 

-কেন?

– তোমার সাথে চিটিং করেছিলাম।

– কিভাবে?

-যে প্রশ্ন তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেই প্রশ্নের উত্তর আমারও জানা ছিল না। শুধু তোমাকে আটকানোর জন্য করেছিলাম। এই জন্য তোমার দুই নম্বর মাইনাস হয়েছিল।

-আরে এসব বাদ দাও, এখন। আমি চিন্তায় আছি আমার বন্ধু ওমরের কী হবে?

– তুমি কি শিউর সে ভিতরে নাই?

– কিভাবে বলি? আমার চোখে তো বালি। ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছি না। 

– আচ্ছা, একটু নিচু হও। আমার কাছে টিস্যু আছে। এই বলে পকেট থেকে টিস্যু বের করে আমার চোখ থেকে বালি বের করার চেষ্টা করছে। চোখের কাছে টিস্যু আনতেই চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এইবার তার মই আমি ডান হাত দিয়ে ধরে রাখলাম। সে বাম হাত দিয়ে আমার চোখের পাতা খোলা রেখে ডান হাতের টিস্যু দিয়ে বালি বের করছে। আমার খুব পছন্দের পারফিউম মাখছে মনে হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম- তুমি কি লায়লা ব্র‍্যান্ডের পারফিউম মাখছ?

– ক্যাম্নে বুঝলে? ও বুচ্ছি। এই ফ্লেভারটা কৃত্তিকার খুব পছন্দ। ওই আমাকে গিফট করেছে। আচ্ছা, কৃত্তিকার সাথে এখনো কি তোমার যোগাযোগ আছে? 

– না, তেমন না। শুধু জানি, এখন সে নরওয়ে আছে। 

এদিকে বিরক্ত হয়ে সবাই বলছে- কি হলো, তাড়াতাড়ি করো। ভেন্টিলেটর আরেকটু ভাঙতেই আবার চোখ মেলাতেই দেখলাম ওমরের পার্সপোর্ট ফ্লরে পড়ে আছে। কিন্তু তাকে তার বেডে দেখা যাচ্ছে না। ভাবলাম এসির সাইডে ঘুমাচ্ছে। এবার হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করতেই ভেন্টিলেটর এর অর্ধেক ভেঙে গেলো। দেখলাম- ওমরের নিশ্চল দেহ পড়ে আছে। নিশ্চুপ, কোন নড়াচড়া নেই। হাত পা চারিদিকে ছড়ানো। দেখে মনে হচ্ছে সে আর নাই। এটা শুনতেই সবাই হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিল। সবাই বুঝতে পারছে না, ক্যাম্নে কি হলো? বাংলাদেশে গিয়ে আমরা কি জবাব দিব? আবার তাকে ডাকা শুরু করলাম- ওমর, এই ওমর, দোস্ত উঠ। কিন্তু তার কোন উত্তর নেই। আরতি বোতলে করে পানি দিচ্ছে ওমরের শরীরে। তারপরও কোন কাজ হচ্ছে না। আমরা একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছি। কারও মুখে কোন কথা নেই। সবার চোখে পানি। ম্যামরা পাগলের মত বিলাপ করে বলছে- কেন, এখানে আসলাম? কী কর‍তে আসলাম? কি থেকে কী হয়ে গেলো? ওমরের বাবা-মাকে কী বুঝ দিব? নিজেরেই বা কীভাবে বুঝ নিব? 

আরতি ওয়াটার বয়কে সাপ্লাই পানির পাইপ নিয়ে আসতে বলল। আমরা দুজন আবার মই দিয়ে উঠে ভেন্টিলেটর এর ছিদ্র দিয়ে পাইপ ঢুকিয়ে ওমরের মাথায় পানি ঢালছি। তবুও ওমর উঠছে না। চারিদিকে শোকার্তের ছায়া। বাতাস ভারী হয়ে গেছে। এরই মাঝে প্রচন্ড ঝড় শুরু হলো। বিদ্যুৎ নেই। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শিলাবৃষ্টি শুরু হলো। বাহিরে থাকার কোন উপায় নেই। সবাই মিলে দরজা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু পুলিশ বললেন- উর্ধতন কর্মকর্তা ছাড়া আমাদের পক্ষে দরজা ভাঙা সম্ভব নয়। এই ঝড়ের মধ্যে থানায় যাওয়ার মতো কোন উপায় নেই। অপেক্ষা করুন। ঝড় থামলে ব্যবস্থা নিচ্ছি।

কিছুক্ষণ আগে আরতি ভেজা শরীরে হোটেলের রিসেপশনে চলে গেছে। মনে মনে ভাবলাম- আরতিকে রিকুয়েষ্ট করলে হয়তো রাখবে। তাই আমি ৩০৩ নম্বর রুম থেকে অন্ধকারে মধ্যে হোটেলের সামনে গেলাম। রিসেপশনের থাই গ্লাসের দরজা একদম লক করা। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আরতি মোবাইলের আলোতে কী যেন লিখছে? আমি কাচের সামনে গিয়ে বারবার ডাকছি। অন্ধকারে ঝড়ের শব্দে আমার কোন কথাই শুনতে পাচ্ছে না। আমার দিকে একবারও তাকাচ্ছে না। আরতির ফোন নম্বরও আমার কাছে নাই যে তাকে ফোন দিব। অবশেষে কৃত্তিকাকে হোয়াটস আপে ফোন দিলাম আরতির ফোন নম্বর নেওয়ার জন্য। কৃত্তিকা ফোন রিসিভ না করে কেটে দিল। কিছুক্ষণ পর টেক্সট করল- ফোন না দিলে খুশি হবো। 

লেখক: প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

Lecturer, Department of English at  |  + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *