মালেক ইকবাল।। 

পরিকল্পনায় ছিল সিমলা আর মানালি। কিছুটা দেরীতে ডিসেম্বরে ভিসা পেলাম। এসময় মানালির কিছু জায়গা অতিরিক্ত বরফের কারণে বন্ধ থাকে। তাই এবারের গন্তব্য ভারতের উত্তরাখন্ডের মুসৌরি। এটি গাড়োয়াল হিমালয়ান রেঞ্জের পাদদেশে অবস্থিত। মুসৌরি উত্তরাখন্ড রাজ্যের একটি শহর। মুসৌরি দেরাদুন জেলায় অবস্থিত। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮৮০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। পর্যটকরা এখানকার সৌন্দর্য্য তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেন। দুন উপত্যকা ও সংলগ্ন পাহাড় তৎসহ সবুজের সমারোহ মুসৌরির প্রধান আকর্ষন। পাহাড়ি এলাকায় পাইন বন শুরু হয়েছে। সংলগ্ন শহর ল্যান্ডরকে ধরা হয় বৃহত্তর মুসৌরির অন্তর্গত। এই সৌন্দর্য উপভোগের জন্য আমরা চার জন  ঢাকা থেকে কলকাতা হয়ে উপাশনা এক্সপ্রেসে রওনা দিলাম। 

১৫০০ কিলোমিটারের প্রায় ৪০ ঘন্টার জার্নি। তারপরও শরীরটা বেশ ফুরফুরা। আমার আবার ট্রেনের শব্দ আর ঝাকুনিতে হেব্বি ঘুম হয়। স্টেশনের পাশেই Oasis Masoori Hotel- এ উঠলাম। ভোর ৫ টা ২৯ মিনিট। সাওয়ার নিয়ে খাটে হেলান দিয়ে রেস্ট নিচ্ছি। হঠাৎ মোবাইলে মেসেজের শব্দ । বরফের শহরে শীতের ভোর। সজাগ থাকলেও মোবাইলটা ধরতে ইচ্ছে করছে না। তারপরও হাতে নিলাম। অপরিচিত নাম্বার মনে হচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম ইন্ডিয়ান এই নতুন Aircel নম্বরে কে মেসেজ পাঠালো? যাই হোক মেসেজটা ওপেন করলাম। পড়লাম, যা পড়তে সময় লাগছে ১ মিনিট ৪১ সেকেন্ডের মত। অনেক লম্বা মেসেজ। একটু সংক্ষেপে বলি- “আমার কিছুই ভাল লাগছে না। এভাবে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছি। সাথে আছে কিছু কাপড় আর সামান্য কিছু টাকা। তুমি যা পারো তাই নিয়ে এসো। আমার ষ্টেশনে পৌঁছাতে আর সময় বেশি লাগবে না। আমার মোবাইলটা অন্য রুমে। তাই কাকন্তের মোবাইল নিয়ে চলে আসছি। তুমি এইটাতেই কল দিও। এই মোবাইলে ব্যালেন্স নাই তবে কয়েকটা ফ্রি sms আছে। তাই মেসেজ দিলাম। আবার কথা বলাও সম্ভব না। সবাই টের পেয়ে যাবে। আমি খুব চিন্তায় আছি। দেখা হলে সব বলবো। ” 

মেসেজটা দেখেই বেডের উপর বসে পড়লাম। কে সে? কাকেই বা মেসেজ দিতে গিয়ে আমাকে দিছে। ট্রু কলারে  চেক করে দেখলাম নাম কাব্য। কয়েক মিনিট বসে ভাবলাম। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। মেসেজে ষ্টেশনের নাম এবং ট্রেনের সময় ও সিট নাম্বার লেখা আছে। কি করি আমি? ভাবলাম ওনাকে কি ফোন করে ব্যাপারটা বলে দিবো নাকি নিজেই যাবো? অহ উনাকে ফোন দিয়ে লাভ নেই? কথা তো বলতে পারবে না। আবার যাকে মেসেজ করেছে সে তো আসবেই না। কারণ সে তো এই বিষয়টা জানেই না। তাহলে তো সে বড় বিপদে পড়ে যাবে। আমি আবার খুবই পরোপকারী। কাউকেই না বলতে পারি না। শেষ পর্যন্ত উঠেই পড়লাম। তাড়াহুরো করে রেডি হলাম। মানি ব্যাগে ৫৬০০ রুপি আছে। বন্ধু রাজ এবং রবিন ঘুমাচ্ছে। না জানিয়েই ওদের সাইড ব্যাগ থেকে আরও কিছু টাকা নিয়ে বের হলাম। 

যাই হোক যতটুকু করা যায়। অন্তত বিপদ থেকে উদ্ধার করে বুঝিয়ে বাসায় পাঠাতে পারবো। ষ্টেশনও তেমন দূরে না। বেরিয়ে পড়লাম এই কনকনে শীতে। সাথে আছে পাহাড়ি উত্তরের বাতাস। ষ্টেশনে পৌঁছালাম। মেসেজে দেওয়া ট্রেনের সময়ও নিকটেই। চারিদিকে তাকালাম। দেখলাম কোথায়ও কেউ নেই। শুধু কয়েকজন গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা মাথার উপর দিয়ে গেল। তাহলে কি সে আসে নাই? নাকি কেউ মজা করছে আমার সাথে? এদিকে ঠান্ডায় আমার হাত পা চলছে না। ১৫ মিনিট হয়ে গেলো কাউকে দেখছি না। ভাবলাম কল দেই। দেখি কোথায় আছে। তখনই টুং করে মেসেজের আওয়াজ। ওরই মেসেজ। লিখেছে,,

” শোন আমি দেরদুইন ষ্টেশনে যেতে পারছি না। আমি তার আগের স্টেশনে দুন এক্সপ্রেসে E বগির ৪৯ নম্বর সিটে থাকবো। তুমি সেখানে আসো। কেন এসেছি তা পরে বলবো। রাখি, বাই”।

আমি তাড়াহুড়ো করে একটা পিকআপ নিয়ে সামনের ষ্টেশনে গেলাম। এর মধ্যে ট্রেনও সেখানে গিয়ে পৌঁছালো। সবাই উঠে গেছে, ট্রেন এখনি ছাড়বে। কিন্তু সে কোথায়? কি করেইবা তাকে আমি চিনবো? ট্রেন চলছে আমিও ট্রেনের সাথে পাল্ল দিয়ে চলছি। দৌড়িয়ে গিয়ে সেই বগিতে উঠলাম। ৪৯ নম্বর সিটে গিয়ে তো আমি অবাক। সেই সিটে কেউ নাই। তবে পাশের ৪৮ নম্বর সিটে দেখি ভোরের মিটিমিটি অন্ধকারে জোৎসনার আলোর মতই সুন্দর একখানা মেয়ে। কোলের উপর ছোট ব্যাগ নিয়ে কালো কাস্মীরী চাদর মাথায় দিয়ে বসে আছে। হাতে মোবাইলে নিয়ে কী যেন করছে? ভাবলাম আমাকে হয়তো মেসেজ করছে। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলাম- দাবা খেলছে। এটা দেখে নিজেকে অদ্ভুতভাবে আবিষ্কার করলাম। নিজের প্রতি রাগ আর ক্ষোভ। কেনইবা আসলাম। ভয়ের সাথে হাল্কা সাহস মিশ্রিত করে জিঙ্গেস করলাম-এই যে শুনুন। 

উনি কিছুটা মাথা উঁচু করে জ্বী বলে আবার দাবা খেলায় মগ্ন হলেন।

– এক্সকিউজ মি, আপনি কি আমাকে মেসেজ দিয়েছিলেন? 

– আজিব তো, আপনাকে কেন মেসেজ দিবো? 

এটা শুনে কথা বলার খেই হারিয়ে ফেললাম। কিছুই বলার নাই। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। ভাবছি, বন্ধুদের মধ্যে আবার কেউ দুস্টামী করলো নাতো? ট্রেন থেকে নেমে গেলাম। স্টেশনে বসে কফি খাচ্ছি আর নিজের বোকামির জন্য অপরাধবোধ হিসেব করছি। এমন সময় আবার একটা মেসেজ আসলো। মেসেজে লিখেছে- “পাইন বনের মধ্যে লেক পার হওয়ার সময় সেন্ডেল ছিড়ে গেছে। আমি আর হাঁটতে পারছি না। শীতে পায়ের তালু একদম শক্ত হয়ে গেছে। আরও দুইটা লেক আছে। বুঝতে পারছি না কিভাবে পার হবো? আমি দুন উপত্যকার লরি স্ট্রিম লেক পার হচ্ছি। তুমি এখানে চলে আসো।” খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। অজানা পাইন বনের রাস্তা। কিভাবে যাই? আশেপাশের মানুষকে জিজ্ঞাসা করে পাইন বনের আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছু দূর যেতেই একটা সাইনবোর্ডে চোখে পড়লো “লরি স্ট্রিম লেক।”জোড়ে নিঃশ্বাস নিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

দূর থেকে একজনের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। সাহস করে এগিয়ে গেলাম। শীতের সকাল। সূর্যের আলোক রশ্মি কুয়াশা ভেদ করে পাইন গাছের ফাঁকে ফাঁকে কিরণ দিচ্ছে। কুয়াশার ধোঁয়ায় কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। চারিদিকে শূন্যতা আর নিস্তব্ধতা। লেকের পানি কলকল শব্দে প্রবাহিত হচ্ছে। 

এরই মাঝে দেখলাম একজন লেক পার হচ্ছে। একদম সাউথ ইন্ডিয়ান মেয়ের মতো। গায়ে ঘিয়ে এবং অফ হোয়াইট কালারের মাঝামাঝি রঙের ছোট থ্রি স্টেপের একটা শাড়ি। পিঠে মাঝারি সাইজের লাল রঙের একটা ব্যাগ। খোপা করা কালো চুলে বেলী ফুলের মালা প্যাচানো। নাক খালি থাকলেও কানে ঝুমকা টাইপের অলংকার। সকালের কচি সূর্যের আলোতে গোলার মালাটা একদম স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ডান হাতে দু তিনটা সোনালী কালারের চুড়ি। বাম হাতে অবশ্য ব্লাউজের সাথে ম্যাচ করে সবুজ রঙের চুড়ি পড়ছে। বাম পায়ে ভর করে ডান পা দিয়ে পানি স্পর্শ করে হাঁটছে। শাড়িটা পায়ের গোড়ালি থেকে হাল্কা একটু উপরে। এজন্যই ডান পায়ের পায়েলটা ক্রিস্টালের মতো দেখাচ্ছে। পায়ে কোন চপ্পল বা সেন্ডেল নেই। এটা দেখে বুঝলাম এই সেই মেয়ে যে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। ডাক দিতে চাইলাম। কিন্তু কি বলে ডাকবো? তার নাম তো আমার কাছে অজানা। একদমই অচেনা মানুষ। জীবনে কখনও দেখি নাই। কি বলে সম্বোধন করবো? ভেবেই পাচ্ছি না। আবার আমার চিন্তা ভাবনা যদি ঠিক না হয় তাহলে তো আরেক বিপদ। এসব ভাবতে ভাবতে একদম তার সামনে চলে আসলাম। আমাদের মাঝে তেমন কোন দূরত্ব নেই। দুজন দুজনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। কারও মুখে কোন কথা নেই। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে বললো – “আমি জানতাম তুমি আসবে। প্রতি উত্তরে আমি কিছুই বলতে পারলাম না। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম আর ভাবতে থাকলাম আসলে বিষয়টা কি? এইবার আরেকটু সামনে এসে আমার গালে ছোট্ট করে একটা থাপ্পড় দিল। 

আমি তো হতভম্ব হয়ে গেলাম। ভয়ে আর শীতে কাপছি। মুখে কোন কথাই আসছে না। হঠাৎ জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলো। আমি চুপচাপ। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল- কী ব্যাপার আমাকে পছন্দ হয়নি? আমি কি এক্কেবারেই খারাপ? কথা বলছ না কেন? তুমি না মোবাইলে কত্ত কথা বলতে। প্রথম দেখা হলে এই করবে সেই করবে! এই দুই বছরে আমরা কত ঘন্টা কথা বলছি, তুমি কি বলতে পারো? দেখ, আজকে আমি কানাডার জয়কো শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করে আসছি। তুমি না এই ফ্লেবার খুবই পছন্দ করো। বিশ্বাস করো জীবনে এই প্রথম তোমাকে দেখলাম। কী যে ভাল লাগছে! এই দিনটার জন্য কত প্ল্যান করছি তার হিসেব নেই। আমি সবসময় ভাবতাম প্রথম যেদিন তোমাকে দেখবো, সেদিনই বিয়ে করবো। এই জন্য বাসা থেকে সব প্রস্তুতি নিয়ে আসছি। তোমার কিচ্ছু কিনতে হবে না। সব আমার ব্যাগে আছে।” এসব শুনে আমার প্রায় রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গেছে। অজানা একজন মানুষকে একজন মানুষ এতটা আপন করতে পারে তা আমার জানা ছিল না। এই বিশ্বাসের মূল ভিত্তি কতটা মজবুত। সেটাও আমার অজানা। আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে তবুও আমি কাঁপছি। আমার কাঁপা দেখে ব্যাগ থেকে একটা চাদর বের করে আমাকে ঢেকে ফেললো।

ভেবেছিলাম তাকে সব কিছু খুলে বলবো। কিন্তু তার এতো আবেগ আর বিশ্বাস দেখে কিছুই বলতে পারলাম না। চাদরের ভিতরই মনের অজান্তে তার শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথায় হাফ ঘোমটা দিয়ে দিলাম। সে তো খুশিতে কান্না শুরু করে দিল। তার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- তোমার সেন্ডেল কোথায়? এইবার তার ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি। আমার এক জোড়া সেন্ডেল একটা করে দুজন পায়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। লরি স্ট্রিম লেক পার হয়ে স্টেশনের দিকে যাত্রা দিলাম। স্টেশনের গেইটে ঢুকতেই দেখি চার পাঁচ জন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। এটা দেখে সে হাটা বন্ধ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। আমিও কিছু বললাম না। তাকে দেখে খুবই ভীত মনে হচ্ছে। হঠাৎ সে আমার বাম হাতটা খপ করে ধরে ফেললো। আর আমার কানের কাছে এসে বলল- প্লিজ, তুমি মুসৌরি স্টেশনে চলে যাও! 

লেখক – প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

Lecturer, Department of English at  |  + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *