মালেক ইকবাল।।
প্রকৃতি সবসময় আপন সাজে সাজতে পছন্দ করে। প্রকৃতির সবকিছুই প্রকৃতির নিয়মে চলতে চায়। মানুষের প্রকৃতি যখন প্রকৃতির প্রতি বিরুপ হয়, প্রকৃতি তখন তাদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর আচরণ করে। প্রকৃতিতে যা স্বভাবিক তাই সুন্দর আবার যা সুন্দর তাই স্বাভাবিক। করোনার কারণে সারা বিশ্ব যখন দিশেহারা প্রকৃতি তখন সাজছে আপন রংঙে । বিশ্বায়ন, শিল্পায়ন, নগরায়ন এবং তথ্য প্রযুক্তি উন্নত বিশ্ব দিতে পারলেও সুখ শান্তি তেমন দিতে পারেনি। এসবের কারণে প্রকৃতি আমাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে এবং করোনার মত অদৃশ্য শত্রুকে সামলাতে সারা বিশ্ব মুখ থুবড়ে পড়ছে।
প্রাণঘাতী মহামারি করোনার থাবায় সারা বিশ্বের মানুষ যেসময় আতংক ঠিক সেই সময় বিপরীত চিত্র প্রকৃতিতে। একের পর এক শহর, দেশ লকডাউন করার কারণে প্রতিদিনই কমছে দূষণের মাত্রা। গত সাত দিনে ইউরোপ আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশে চোখ পড়েছে ঝলমলে নীল আকাশ। মেট্রোপলিটন শহরে মানুষ নিচ্ছে সজীব নিংশ্বাস। লোকালয়ে ফিরছে বিরল পাখি ও কীটপতঙ্গ। বিশোধন নীল আকাশ আর নির্মল বাতাস উপভোগ করছে ইউরোপীয়রা। যার পুরো কৃতিত্ব মরণঘাতক করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯ এর। পরিবেশবিদদের নানা বিক্ষোভ ও প্রতিবাদী কর্মসূচী, রাস্ট্র নেতাদের গালভরা বুলি এবং জলবায়ু সম্মেলন এতদিন যা সম্ভব করতে পারেনি, করোনা তাই করে দেখিয়ে দিল।মহামারির আতংকে মুহুর্তেই লকডাউন নামে তালা পড়লো কারখানায়, উবে গেল কালো ধূয়া এবং বন্ধ হলো দূষণ।
রয়েল নেদারল্যান্ডস মেট্রোলজিক্যাল ইন্সটিটিউট সম্প্রতি পাল্টে যাওয়া ইউরোপের মানচিত্র প্রকাশ করে। তাতে স্পষ্ট দেখা যায় নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড পরিবর্তন করছে তার গতিপথ। একারণে দ্রুত গতিতে কমছে বাতাসে দূষণের মাত্রা। সারা বিশ্বে যান চলাচল কমেছে এক চতুর্থআংশ, যার কারণে কমেছে কার্বন ডাই-অক্সাইড এর মাত্রা। প্রকৃতির দূষণ কমছে ৫ শতাংশ পর্যন্ত। যা গত ৭৫ বছরেও ছিল অসম্ভব। প্রিথিবী ২য় বিশ্ব যুদ্ধের আগের প্রকৃতিতে ফিরে গেছে। ডাচ মেড অফিস কুপারনিকাস সেন্টিনাল ফাইভ পি উপগ্রহ থেকে পরিক্ষা করা হয় বায়ুমন্ডলে নাইট্রোজেন এর মাত্র। যাতে গত বছরের মার্চের চেয়ে এবছররে তারতম্যটা স্পষ্ট। যাকে পরিবেশের জন্য ইতিবাচকই মনে করছেন পরিবেশবিদরা। এ কারণে লোকালয়ে ফিরছে নাম না জানা বিরল প্রজাতির নানা পাখি ও কীটপতঙ্গ। মানুষের অপ্রাকৃতিক আচরণের জন্য পশু পাখি লোকালয় ছেড়ে চলে যায়। কিন্ত লোকডাউন, কারফিউ আর মানুষ ঘরে আটকে পরায় কমে এসেছে যান্ত্রিক শব্দ। ইউরোপ আমেরিকার মানুষ কান পাতলেই এখন শুনতে পাচ্ছে রেড কারডিনাল বা আমেরিকার রবিন এর সুমধুর গান। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে বিশ্বের ট্রাফিক কমেছে ৩৫ শতাংশ। নিউইয়র্ক আর দিল্লির মত ব্যস্ত শহরগুলোয় দশভাগ নিম্নমুখী ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমান। যার ফলে আবারও নিঃশ্বাস নেওয়া শুরু করছে মৃত প্রায় ধরিত্রী।
এই দানব ভাইরাসের ফলে পৃথিবীর গতিবিধিও বদলে গেছে। কারণ, মানুষ বাইরে যাচ্ছেনা বলে গাড়ি-ট্রেন চলছে খুবই কম, লাখ লাখ ভারি শিল্প-কারখানা এখন বন্ধ। আর এর ফলে, ভূ-পৃষ্টের ওপর চাপ কমে গেছে অনেক। ফলে পৃথিবী কাঁপছে কম। পৃথিবীর ওজন ছয় বিলিয়ন ট্রিলিয়ন টন। সেই বিবেচনায় এই পরিবর্তন বিস্ময়কর।
পৃথিবীর কাঁপুনি যে কমে গেছে তা প্রথম লক্ষ্য করেন বেলজিয়ামের রয়্যাল অবজারভেটরির বিজ্ঞানীরা। তারা বলেন – “লকডাউনের আগের তুলনায় ১-২০ হার্টস ফ্রিকোয়েন্সিতে (বড় একটি অর্গানের আওয়াজের যে ফ্রিকোয়েন্সি) ভূ-পৃষ্ঠের দুলুনি এখন অনেক কম।”
আবার দিল্লি, মুম্বই, কলকাতার মতো ব্যস্ত শহরে কমেছে ধূলো-বালি আর ধোঁয়া। পরিষ্কার হচ্ছে শহরের আকাশও। অনেক অচেনা পাখির দেখা মিলছে বাড়ির জানলার সামনে, পাড়ার গাছ-গাছালির ডালে।
আইআইটি বিএইচইউ-এর কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি-র অধ্যাপক ডঃ পিকে মিশ্র বলেন, এই ক’ দিনের লকডাউনে গঙ্গায় এবং যমুনায় দূষণ কমেছে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। গঙ্গোত্রী থেকে বঙ্গোপসাগর— সব জায়গাতেই পরিষ্কার হয়েছে গঙ্গার বিপুল জলরাশি যা দেখে হাসি ফুটেছে পরিবেশবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মুখে। দূষণের অভিশাপ কাটিয়ে যেন প্রাণ ফিরে পাচ্ছে দেশের ঐতিহ্য, ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই নদীগুলি।
অন্যদিকে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার মানুষের আমানবিক কলরবে যখন নিজস্ব প্রকৃতি হারাচ্ছিল তখনই কোভিড-১৯ এর প্রভাবে দেখা দিল বিরল দৃশ্য। নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে পর্যটকশূন্য কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কাছে ভেসে বেড়ালো ডলফিনের দুটি দল। দুটি দলে মোট ২০-২৫টা ডলফিন আছে।” সেখানে রয়েছে একটি গোলাপি ডলফিন। গোলাপি ডলফিন হলো ইন্দো প্যাসিফিক হাম্পব্যাক ডলফিন। বাংলাদেশের সাগরে যে ছয় ধরনের ডলফিন আছে তার মধ্যে এটি একটি। আবার পর্যটকশূন্য সৈকতে হাজার হাজার কচ্ছপ জড়ো হচ্ছে ডিম পাড়তে। কিছু কিছু সাগর তীরে বসছে নানা প্রজাতির কাকড়ার মেলা। এইভাবে প্রকৃতি ফিরে পাক হারানো নৈসর্গিক সৌন্দর্য।
তবে আশা করি করোনা নয় মানুষ করোনাকে মোকাবেলা করে আবার প্রকৃতিকে তার প্রকৃতি ফিরে দিয়ে এই পৃথিবীকে করে তুলবে বাসযোগ্য এবং শান্তিপূর্ণ।
লেখক – প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।