মালেক ইকবাল।।
ধর্মযাজকের কন্যা থেকে ‘ইউরোপের সম্রাজ্ঞী’ হয়েছেন এঙ্গেলা ম্যার্কেল। সুদীর্ঘকাল তিনি জার্মানির ক্ষমতায় আসীন রয়েছেন। নিজেকে তিনি একজন বিচক্ষণ ও বাস্তববাদী নেতা হিসাবে প্রমাণ করেছেন। একসময় তাকে বর্ণনা করা হতো ”জার্মানির রানি” হিসাবে। এমনকী কেউ কেউ তাকে ডাকতেন ”ইউরোপের সম্রাজ্ঞী” বলে। করোনা মহামারির সময়েও তিনি রানির আসনে অবস্থান করছেন। করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত সফলতার লাইনে জার্মানি এগিয়ে যেখানে আমারিকার মতো অনেক দেশই কারোনা মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে।
সারা বিশ্বেই আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা বিরাজমান। কোথাও কোথাও লকডাউন চলছে। এই পরিস্থিতিতে জার্মানিতে করোনা মুক্ত বাতাস বইছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে,জার্মানিতে সুস্থ হওয়ার হার বেশি এবং মৃত্যুর হার যেকোনো দেশের থেকে কম। জার্মানির এই সাফল্যের পিছনে রয়েছে একজনের অসাধারণ নেতৃত্ব। ঘুরেফিরে বিভিন্ন জায়গাতেই একই প্রশ্ন করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য কারণ অনুসন্ধান করে দেখা যাচ্ছে যে চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের দরদি ও দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও কারিগরি দক্ষতা জার্মানিকে করোনা মোকাবিলায় এ পর্যন্ত সাফল্য এনে দিয়েছে। করোনা পরিস্থিতি বিস্তৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ১১ মার্চ আঙ্গেলা ম্যার্কেল ভাষণ দেন। তাঁর ভাষণটি ছিল অত্যন্ত ইতিবাচক ও বাস্তবভিত্তিকি। তিনি তথ্য নিয়ে লুকোচুরি করেননি কিংবা নিয়তির ওপর নির্ভর করেননি।
তিনি শুধু একটি দেশের সরকার প্রধানই নন, তিনি একজন বিজ্ঞানীও বটে, তিনি যখন করোনাভাইরাস নিয়ে প্রেস ব্রিফিং করেন তখন তা মনেই হয়না যে একজন সরকার প্রধান বলছেন, বরং মনে হয় একজন সাধারণ প্রতিবেশিনী যিনি তার প্রতিবেশীদেরকে করনীয় কিছু পরামর্শ দিচ্ছেন এবং সেই পরামর্শ গুলো অত্যান্ত জরুরী, লোকজন মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শোনেন। জার্মানদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ম্যার্কেল বলেন, পরিস্থিতি আতঙ্কজনক, আপনারা সবাই আতঙ্কিত হবেন। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ জার্মান আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমাদের জয়ী হতে হবে। এবং আমরা সবাই মিলে জয়ী হব। আঙ্গেলা মার্কেল তাঁর প্রেস ব্রিফিং করার সময়, রবার্ট কোখ ইনস্টিটিউট RKI (করোনা রোগ পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ফেডারেল সরকারের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান) এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলছিলেন, ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার আবার বেড়েছে।
তদনুসারে, তথাকথিত প্রজনন হার আবার 1 হয়েছে এর অর্থ প্রতিটি সংক্রামিত ব্যক্তি অন্য একজনকে সংক্রামিত করছে। সহজ করে বুঝিয়ে দিলেন কথাটি এবং বললেন এই প্রজনন সংখ্যা ১ এর নিচে রাখতে হবে, তাহলেই এই মহামারী তিন মাসেই চিরতরে বিদায় নেবে। জার্মানিতে নতুন রোগের সংখ্যা গত কয়েক দিনে সামান্য হ্রাস পেলেও প্রজনন হার কম হয়নি। RKI এর হিসেবকেই চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল আবার বারবার জোর দিয়ে বলেছেন যে মহামারীটি রক্ষার জন্য পুনরুত্পাদন গুলোর সংখ্যা (Number of reproductions) 1 এর নিচে হওয়া উচিত। শুধু ম্যার্কেল নন, সব জার্মান রাজিনৈতিক নেতাই পরিশীলিত, বুদ্ধিদীপ্ত ও সংযত আচরণ করেছেন। জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্রাংক ভাল্টার স্টাইনমায়ার ইস্টারের ভাষণে বলেন, এটা কোনো জাতি বা সৈনিকের বিরুদ্ধে লড়াই নয়। এটা মানবতা পরীক্ষার লড়াই। তাই তো জার্মানি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ইতালি ও ফ্রান্স থেকে রোগী এনে চিকিৎসা করেছে।
জার্মান রাজনীতিবিদেরা কখনোই অন্যান্য দেশের রাজনীতিবিদদের মতো যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প, ব্রিটেনের বরিস জনসন বা ইরানের আলী খামেনির মতো উদভ্রান্ত আচরণ করেননি এবং করোনা সম্পর্কে উল্টা পাল্টা মন্তব্য করে সমালোচিত হননি।ষড়যন্ত্র না খুঁজে বরং করোনা প্রতিরোধে মনোযোগ দিয়েছেন। সবাই একযোগে কাজ করেছেন। আমলাতন্ত্রের ধীরগতির জন্য সুবিদিত জার্মান প্রশাসন খুবই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জার্মানির কোনো রাজনৈতিক নেতা বলেননি, ম্যার্কেলের মতো নেতা থাকায় জার্মানিতে করোনা আসবে না। বা কেউ বলেননি, ম্যার্কেল সকালে বাইবেল পাঠ করে দিনের কাজ শুরু করেন। নিয়তির ওপর নির্ভর না করে বরং জনগণের প্রতি তাদের নিবেদন ছিল লক্ষণীয়। জনসাধারণকে রক্ষা করতে পারবেন কি না, আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারবেন কি না, সেই শঙ্কায় রাজ্যের অর্থমন্ত্রী ঠোমাস শেফের আত্মহত্যা পর্যন্ত করেন। এ থেকেই অনুধাবন করা যায়, জার্মান রাজনীতিবিদেরা বিষয়টি কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন। ম্যার্কেল রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন দক্ষ পেশাজীবী ও গবেষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পন্ডিতদের। ম্যার্কেলের দৃঢ়চেতা ও স্পষ্টবাদী নেতৃত ছিল এককথায় অনবদ্য। তিনি ঘরে ও বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই নিজস্ব ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোরকালে ম্যার্কেলই একমাত্র জার্মান চ্যান্সেলর, যিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের চোখে চোখ রেখে কথা বলেছেন। ন্যাটোতে জিডিপির ২ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়ার নিয়ম থাকলেও ম্যার্কেল বলে দিয়েছেন, ১ দশমিক ২ শতাংশের বেশি দেওয়া সম্ভব নয়।
তিনি জার্মানির সামরিক ব্যায় সংকোচনের পক্ষে। বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ বাতিল করেছেন। সর্বশেষ আর্থিক মন্দার তাপ খুব বেশি জার্মানদের গায়ে পড়তে দেননি। তিনি এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়নকে আগলে রেখেছেন একহাতে। দল ও অনেক নাগরিকের মতের বাইরে গিয়ে সিরীয় উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিয়েছেন। কথা বলেন অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায়। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে বন শহরে তাঁর ভাষণ শুনে কখনোই মনে হয়নি কোনো রাজনৈতিক নেতা ভাষণ দিচ্ছেন। সেটা ছিল অতিপরিচিত কারও আলাপ শোনার মতো। সেই ভাষণে ছিল পরামর্শ, ছিল নির্দেশনা। ছিল না প্রতিহিংসার কোনো বিষবাষ্প। তিনি গোটা ভাষণে একবারও প্রতিপক্ষ সোশ্যাল ডেমোক্রেট প্রার্থী মার্টিন শুলজের নাম উচ্চারণ করেননি। এ জন্য তিনি এখন সারা বিশ্বে নন্দিত। ম্যার্কেলকে জার্মানরা আদর করে ‘মা’ বলে ডাকেন।
জার্মান ভাষায় বলেন ‘উনজেয়েরে মুটি’। মানে, ‘আমাদের মা’। ম্যার্কেল আরও একবার তাঁর প্রায় আট কোটি সন্তানকে আগলে রাখলেন যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে। না তিনি কোনো হুমকি দেননি। কাউকে জেলে পোরার ধমকও দেননি। বরং তিনি সবাইকে ভালবেসে মন জয় করেছেন।
লেখক: প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ।