মালেক ইকবাল।। 

ভোর ৫ঃ১৯ মিনিট। সারাদিনের পাহাড়ি রাস্তার ক্লান্তি শেষে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেছি। হঠাৎ দরজায় নক। এমন সময় আবার কে এলো? চিন্তায় পড়ে গেলাম। হার কাপানো শীত। সাদা কম্বল গায়ে হাত পা গুটিয়ে শুয়ে আছি। কম্বল থেকে মুখ বের করতেই আবার দরজায় নক। কিছুতেই উঠতে ইচ্ছে করছে না। দার্জিলিং এর হোটেল গুলোতে থাই গ্লাস থাকবেই। না হলে আবার মেঘ এসে সবকিছু ভিজিয়ে দিয়ে যায়। চোখ মেলতেই দেখি মেঘের রাশি দল বেধে ছুটছে। এখানে মেঘের কাছে যেতে হয় না, মেঘই কাছে আসে। আড়মোড়া দিয়ে পাশ ফিরে ঘুমালাম। আবার দরজায় সেই নক। এবার অবশ্য একটু জোরে। কিছুটা ভয় পেলাম। তারপরও উঠতে বাধ্য হলাম। দরজা খুলতেই দেখি দুজন নেপালি মেয়ে ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। 

আকস্মিক তাদের আবির্ভাবে হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কী ব্যাপার, এত সকালে আপনারা এখানে, কী চাই? আমার কথার টোন শুনে উনারা বুঝতে পারলেন যে এরকম অবস্থায় আমি কখনো পড়ি নাই। অপ্রস্তুত হয়ে বললেন – সরি স্যার, আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম মনে হয়! প্লিজ, কিছু মনে করবেন না। আমরা কয়েকটা শাল এবং চাদ্দর নিয়ে আসছি। পছন্দ হলে নিতে পারেন। একদম কম দামে বিক্রি করি। এটা শুনে স্বস্তি পেলাম। আমি আবার অন্য কিছু ভেবেছিলাম। ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে বললাম- প্লিজ, আপনারা এখন যান। আমার শাল টাল লাগবে না। আমার বিরক্তি ভাব দেখে একজন ব্যাগ নিয়ে চলে গেলেন। অন্যজন দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করছেন। এরই মধ্যে ম্যাম আমার সামনে এসে হঠাৎ হাজির। কিছুটা আড়ি চোখে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- এই মেয়েটা কে? তার সাথে এখানে কি?  

– ম্যাম, আমি তাকে চিনি না। উনি শাল বিক্রি করতে আসছে। 

– এসব আমাকে বুঝাও, তাই না? এত ভোর রাতে শাল বিক্রি করতে আসছে! তার হাতে শাল কই? 

– জ্বি ম্যাম। আরেক জন ছিল। উনি শালের ব্যাগটা নিয়ে ওইদিকে গেছে। প্লিজ ম্যাম, বিশ্বাস করেন। 

কথার মোড়টা ঘুরিয়ে বললাম- ম্যাম, একটা কথা বলার ছিল।

– কিছুটা রাগান্বিত হয়ে জ্বি, বল। 

– ম্যম, স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি স্নো ড্রপ্স স্কুলে ক্লাস নিচ্ছি। বাচ্চারা খুব মজা করে আমার ক্লাস এনজয় করছে। 

– আমি বুঝলাম না। তুমি বিষয় টা নিয়ে এত সিরিয়াস কেন? সে এমন কী বলছে বা তার সাথে এমন কী হইছে যে তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে হবে! 

আমিও বুঝতেছি না। তার সাথে তো তেমন কিছু হয় নি। কিন্তু আমার এমন হচ্ছে কেন? তবে তার সাথে টাইগার হিলে কাটানো সময়টা খুব দারুণ ছিল। কোনভাবেই ভুলতে পারছি না। কিন্তু আবার দেখা করতে বললো কেন, বুঝলাম না? তবে মনে রাখার মত তো কিছু হয় নি। মনে করার চেষ্টা করছি তার সাথে কি কি হয়েছিল? যা হয়েছিল সেটা তো ভোর রাতে টাইগার হিলে শীতের মধ্যে। আচ্ছা সেখানে কেন গিয়েছিলাম? ও তখন না মনে মনে ভাবছিলাম, দার্জিলিং এ আসছি, টাইগার হিল আর কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখব না। সেটা কি হয়? সান রাইজিং দেখার জন্য একদম ভর রাতেই টাইগার হিলে যেতে হয়। প্রথমে পাহাড়ি পথ বেয়ে জিপে করে গেলাম টাইগার হিলে। দেখলাম, আরো অনেক ট্যুরিস্ট অপেক্ষা করছে। নিচু উচ্চতায় সূর্যকে দেখতে পাওয়ার আগেই কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরগুলি আলোকিত হয়ে উঠলো ধীরে ধীরে। দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘার অভূতপূর্ব দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাসই হবে না! 

পৃথিবীপৃষ্ঠের বক্রতার জন্য টাইগার হিল থেকে মাকালু পর্বতকে মাউন্ট এভারেস্ট থেকে উঁচু মনে হলো। আকাশ বেশ পরিষ্কার হতে থাকলো ধীরে ধীরে। দক্ষিণে কার্শিয়াং শহর এবং কিছু দূরে দক্ষিণেই তিস্তা নদী, মহানন্দা নদ, বালাসোন নদ ও মেচি নদীকে সর্পিল পথে এঁকে বেঁকে চলতে দেখা গেলো। চোলা পর্বতমালার পিছনে অবস্থিত তিব্বতের চুমল রি পর্বতটিও চোখে পড়লো। প্রচন্ড শীতে এমনভাবে কাপছি যেন দাঁতে দাঁত খাবি খাচ্ছে। পিছন থেকে হঠাৎ একজন কারও নাম ধরে ডাকছে। আমি অপলক দৃষ্টিতে টাইগার হিলের সূর্যোদয় উপভোগ করছি। এইবার কাধে আলতো করে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- কী খবর তুমি এখানে, কেমন আছো? হঠাৎ এখানে কি মনে করে?  

চমকে উঠে পিছনে ফিরে জিজ্ঞেস করলাম- বুঝলাম না, আপনি কাকে কি বলছেন? কোন কিছু না বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। আমার পা হতে মাথা পর্যন্ত কি যেন দেখছেন? তার ভিতরের অপরাধবোধ আমাকে বিচলিত করলো। তার মনটা ভীষণ খারাপ। আমি নিজেও কারণটা বুঝলাম না। চলার অভিপ্রায়ে বললেন- 

এক্সচুয়েলি সরি, প্লিজ মাফ করবেন। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি? 

– জ্বি, করুন।

– আপনি কি মধুবালা স্টেশনে কখনও গিয়েছেন?

– জি!

– আপনি কি কারও কাছে হেডফোন চেয়েছিলেন? 

-জি!

-আপনার কাছে কি কেউ চা খেতে চেয়েছিলেন? 

-জি!

-আচ্ছা, আপনি কি জি জি ছাড়া কিছু বলতে পারেন না?

-জ্বি!

– উফ, আবার জি! আরেকটা প্রশ্ন করি?

-জ্বি।

– আপনারা কি এবার সামিট হারমন হোটেল থেকে আসছেন? 

এইবার আমি খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- জ্বি, কেন বলুন তো? 

– আচ্ছা, আপনাদের জিপ নম্বর কি WB-092764?

– আরে, আজিব বিষয় তো! আপনি কেমনে জানলেন? আর এত কিছু কেন জিজ্ঞেস করছেন? আপনি কি করেন? 

– তেমন কিছু করি না। টাইগার হিলে চা বিক্রি করি। আপনি কি এই প্রথম বার আসছেন? 

– জ্বি, কিন্তু আমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে আপনি চা বিক্রি করেন! আর কি করেন? 

–  আমি Lumbini Buddhist University তে অনার্সে পড়ি।

– তাহলে চা বিক্রি করেন, বুঝলাম না?

– হুম, ভোর ৪ টা থেকে ৬ টা পর্যন্ত টাইগার হিলে চা বিক্রি করি। 

– ওয়াও, তারপর! 

-সকালে স্নো ড্রোপস স্কুলে ক্লাস নিই। আবার ১১ টা থেকে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত ভার্সিটিতে ক্লাস করি। সন্ধ্যায় মাঝে মাঝে বাবার দোকানে বসি। ভার্সিটি বন্ধ থাকলে আবার টুরিস্ট গাইড এর কাজও করি।

– কি বলেন? এত্তকিছু একসাথে কিভাবে করেন?

– আসলে আমাদের এখানকার পাহাড়ি জীবন টা এমনই। বলতে পারেন আমরা সবাই খুবই পরিশ্রমে অভ্যস্ত। আরেকটা বিষয় আমাদের মধ্যে অনেকেই সময়ের সাথে কাজ করেন না বরং তারা কাজের জন্য সময়কে ভাগ করে সঠিক ব্যবহার করেন। এরা কিন্তু জীবনে অনেক দূর এগিয়ে যায়। তাই আমিও একটু চেষ্টা করছি।

– দারুণ তো। কিন্তু আমি শুনেছি এখানকার মানুষ জন কিডনি বিক্রি করে! 

-পাহাড়ী জীবন খুবই কঠিন। এখানে অনেক চ্যালেঞ্জ নিতে হয়। অভাব আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। কিছু লোভী মানুষ এই দুর্বলতাকে অপব্যবহার করে। কিডনি ভ্যালি হিসেবে কুখ্যাত আমাদের হোকসে গ্রামের প্রায় সবাই দালালের খপ্পরে পড়ে কিডনি বিক্রি করে। তাদের চিন্তা ভাবনা এমন যে- নখ কাটলে নতুন নখ হয়৷ চুল কাটলে ফের গজায়৷ তেমনই কিডনিও ফের তৈরি হয়ে যায়৷

-কিন্তু! এরপর আর কিছু বলতে পারলাম না। মনে মনে ভাবলাম – আমরা কত আরাম আয়াশে দিন কাটাই। আর এরা! 

– আচ্ছা! আপনাকে যদি আমাদের বাসায় আসতে বলি, আপনি আসবেন?

– কিন্তু, কেন, বলুন তো?

– না, মানে! আপনাকে একটা ছবি দেখাবো।

– কার ছবি? 

– গেলেই দেখতে পাবেন। আচ্ছা, আপনার শীত করছে তো, একদম কাপছেন! শীতের ভারী পোশাক কই?

– হোটেল থেকে গাড়িতে তুলতে ভুলে গেছি। 

– যদি কিছু মনে না করেন, এইটা ব্যবহার করতে পারেন! 

– কিন্তু, আপনি! 

– না, আমার লাগবে না। 

– এখন যদি এক কাপ গরম গরম চা হতো তাহলে শীত একটু কম লাগতো। 

– সরি, আসলে চা শেষ হয়ে গেছে। আমার কাছে চা পাতা আর চিনি আছে কিন্তু পানি নেই।

– আচ্ছা, ওই যে মেঘ জমে আইস ডায়মন্ড এর মতো চিকচিক করছে ওটা দিয়ে চা বানানো যায় না?

– ওয়াও, দারুন একটা আইডিয়া আসছে। আমার কাছে ছোট্ট একটা স্টিলের বোতল আছে। ওটার মধ্যে আইস ভরে পানি গরম করি।

– কিন্তু মেঘের আইস ত অনেক দূরে। পাবেন কই?

-প্লিজ, চলুন আমার সাথে।

 এই কথা বলে পাহাড়ি একই পথে দুজনের হাটা। কারও মুখে কোন কথা নেই। ঢালু আর মেঘ ভেজা পথে হাটতেই দু একবার পিছলে যাবার উপক্রম। তার এক হাতে চায়ের বক্স আর অন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন- প্লিজ, হাতটা ধরুন, না হলে পড়ে যেতে পারেন! আমি কি করবো, কিছুই বুঝতে পারছি না? হাতটা বাড়িয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন। ইশারায় কি যেন বলছে, বুঝার চেষ্টা করলাম না। এইবার কৃত্তিকা সরি বলে হাতটা গুটিয়ে নিতে চাইলো। আমি বললাম- ওকে। ঘাসের উপর মেঘ জমে আইসের মতো দানা বেঁধে আছে। সেগুলো তুলে স্টিলের বোতলের মধ্যে নিলো। দুইটা ইট পাশাপাশি রেখে তার উপর বোতলটা রাখলো। এখন পানি গরম করার পালা। ব্যাগের মধ্যে থেকে গ্যাস লাইট বের করলো। আমি বললাম -কী ব্যাপার আপনি!

-না, আমি স্মোক করি না। তবে গ্যাস লাইট রাখি। এখানে অনেক ভূত থাকে। ওরা আবার আগুনে ভয় পায়৷ ভূত সামনে আসলে আগুন জ্বালিয়ে দিলে পালিয়ে যায়। পাতার স্তুপের নিচে থেকে শুকনো পাতা বের করে আগুন জ্বালিয়ে দিল। আমি আগুনের উপর বোতল ধরে রাখলাম। আঙ্গুলে তাপ লাগতেই বোতল ছেড়ে দিলাম। অল্প পরিমাণ পানি গরম হলো। চা বানানোর পর দেখা গেলো হাফ কাপ চা। 

পরের দিন সকাল ৯ টায় আমরা সবাই তার বাসায় গেলাম। বাড়িটা কাঠের তৈরি। কি সুন্দর কাঠের কারুকার্য! বাসার সামনে পুকুর। তার মধ্যে মাচা সিস্টেমে একটা ব্যতিক্রমী খাবার হোটেল। পুকুরের মধ্যে অনেক বড় বড় মাছ খাবি খাচ্ছে। খাবার দিলেই তারা ভেসে উঠে। এসব দৃশ্য দেখতে দেখতেই পর্যটকরা সেখানে খাবার খায়। আমাদেরকে কৃত্তিকা সেখানে নিয়ে গেল। তার বাবার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল। তিনি কৃত্তিকাকে নাস্তা দিতে বললেন। বিভিন্ন বাহারি নাস্তা ছিলো যেমন তিব্বতী মমো, থুকপা, চুর্পি, সাফালাই, বারফি, আলির দম এবং দার্জিলিং এর চা। পাশের রুম থেকে কৃত্তিকা ইশারায় ডাকলেন। আমিও না গিয়ে পারলাম না। তার মুখটা মলিন। কোন কথা নেই। একদম চুপচাপ ঠিক আমারিকার ক্যারোলিনা পর্বতের মতো যেখানে জেরী কাঠ কাটতো। আমি জিজ্ঞেস করলাম- কিছু কি বলবেন?

-না।

– তাহলে ডেকেছেন কেন?

– প্লিজ, আপনি আমাদের এখানে থেকে যান।

– কি বলছেন এসব! আমি এখানে থাকবো কেন?

– ঠিক, আসলেই তো, কেন থাকবেন? তারপরও মানুষ থাকে তো, তাই না?

– কী পরিচয়ে থাকবো?

– থাকবেন, ওই তো ওই পরিচয়ে!

– কোন পরিচয়ে?

– না, মানে!

– বুচ্ছি, আমার জন্য আমার জায়গায় ঠিক।

কিছু না বলে নাস্তার রুমে চলে আসলাম। নাস্তা করা প্রায় শেষ। কিন্তু কোথাও কৃত্তিকা নেই। তার বাবা ডাকতে শুরু করলো। কোন উত্তর নেই। আমরা বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। এমন সময় তার বাবা বললেন- চলুন মাটির নিচে একটা রুম আছে। ওখানে যাই। কৃত্তিকা মাঝেমাঝে ওই রুমে একা একা কথা বলে। আমরা সবাই মিলে সেখানে গেলাম। দেখলাম- কৃত্তিকা কাঠের দেয়ালে ঝুলানো একটি ফটোগ্রাফের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কী কী যেন বলছে?

লেখক: প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

Lecturer, Department of English at Tejgaon College | + posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *