মালেক ইকবাল।।
ফার্মগেটে সেজান পয়েন্টের গলিতে ফুচকার দোকানের সামনে হঠাৎ দেখা। আনুমানিক ৯ বছর পর। একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন- আরে তুমি এখানে! ক্যামন আছো?
কোন উত্তর না দিয়ে চুপ থাকলাম। আবার জিজ্ঞেস করলেন- এই, ক্যামন আছো?
-আগের চেয়ে ভালো।
– কেন, আগে ক্যামন ছিলে?
– ভালো।
-এখন?
– আরও ভালো।
– কেন?
– এই যে বহুদিন পর আপনার সাথে দেখা হলো।
– তোমার হেয়ালি মার্কা কথাবার্তা আগের মতোই আছে। একটুও পরিবর্তন হয় নি।
– আমি বহুরূপী না। পরিবর্তন হই না। একটা কথা বলি?
– হুম, বলো।
– আমি ভালো থাকলেও আপনি কিন্তু ভালো নেই।
– ক্যাম্নে বুঝলে?
– ওই যে, আপনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেমন আছো?
-এটা কি ফুচকাওয়ালার জীবন দর্শন? আচ্ছা, তোমার কি মনে আছে? আমাদের প্রথম কোথায় দেখা হয়েছিল?
– কেন, মনে থাকবে না? আমার মন কি ছোট নাকি যে, মনে থাকবে না!
– কোথায়?
– ওই তো জাহাঙ্গীরনগর পুকুর পাড়ে শাড়ি কিনতে গিয়ে দেখা হয়েছিল।
– এখনো কি যাও ওখানে?
– না, যাই না। ওখানে গেলে মনটা স্লো হয়ে যায়!
– কেন?
-কারণ টা খুঁজে নিই তারপর বলছি।
মনটা স্লো হওয়ার কারণ খুজছি। কত জনের সাথে কত ঘটনা! তারা কোথায় যায়! অনেক দিন আগের কথা হলেও মনে হচ্ছে এইতো সেইদিন জাহাঙ্গীরনগর গেলাম। তারপর পুকুর পাড়ে শাড়ি কিনছি। কিন্তু কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না। শাড়িওয়ালা মামা বললেন- আপনি বলেন, যার জন্য শাড়ি নিবেন তিনি দেখতে কেমন?
-কিভাবে বুঝাই দেখতে কেমন?
-মামা, এখানে এত্ত এত্ত মেয়ে। একজন দেখিয়ে বলেন কার মতো। আচ্ছা, দাঁড়ান। ওই দেখেন কয়েক জন মেয়ে আসছে। এইবার বলেন, দেখতে কার মতো।
ইশারায় দিয়ে বুঝালাম তার মতো। শাড়িওয়ালা মামা বললেন- আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি উনাকে ডাকছি।
-আরে মামা, আপনি ডাকবেন! কী মনে করবে কে জানে?
– সমস্যা নাই, আমার পরিচিত। কিচ্ছু মনে করবে না। মামা তাকে ডেকে ব্যাপারটা বললো।
তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- কার জন্য কিনবে?
বয়সে একটু বড় হবে। তুমি করে বললেন। তাই কিছু মনে করলাম না।
-না, মানে। কারও জন্য কিনব না। এমনি কিনব তাই।
– আরে বলো, সমস্যা নাই। আচ্ছা বলো দেখতে কেমন?
-ক্যাম্নে বলি, দেখতে কেমন! মনে করেন, আপনার মতো।
-আমি ভাবছিলাম, তুমি খারাপ। এখন দেখছি, আসলেই খারাপ।
-কিছুটা অনুশোচনার সাথে বললাম- ভুল হলে, সরি।
-চেহারা এমন কেন তোমার? কিছু মাখো নাকি? মৃদু হেসে উত্তর দিলাম-হুম, মাখি, রোদের আলো।
– ডং তো ভালোই পারো। আচ্ছা, আর কি পারো?
– খেলতে পারি।
– কি?
– দাবা, সরি, আমি কিন্তু ওইটা বুঝাই নাই, যেটা আপনি বুঝছেন।
– আজিব, আমি কি বুঝছি?
– ওই তো, দাবা।
একটু সময় নিয়ে বলল, এখনকার ছেলেগুলা সব বদের হাড্ডি। কথায় পারা যায় না। যেহেতু তুমি এত্ত পারো। চলো দাবা খেলি। দেখি কে কেমন পারে? আমি কিন্তু তোমাকে বলে কয়ে হারাব।
রোদের মধ্যে একটা গাছের ছায়ার নিচে দাবা খেলা শুরু করলাম। ওপেনিং গেমের অংশ পার হবার পরই বুঝলাম এ ঝানু খেলোয়াড়, মিডল গেমেই হেরে যাব। ইন্ড গেমে যাবার যোগ্যতাও আমার নাই। তারপরও আমি চাপা মেরে বললাম- আরে, আপনি আমার সাথে তাই পারেন! আমি কিন্তু ইচ্ছে করেই হারবো। পরে যদি মন খারাপ করেন।
মেয়ে মুখ বাঁকিয়ে বললেন- ধ্যাত! আগে জিতে দেখাও না, দেখি কেমন পারো!
– ওপেনিং দেখে কি মনে হচ্ছে, খেলা পারি না? কিছুটা বিভ্রান্ত টেনে উচ্চারণ করল, হুম পার, কিছুটা বুঝা যাচ্ছে। বাট আমার সাথে পারবে না।
– আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
– হ্যাঁ, বলো।
-আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
কিছুটা হতচকিয়ে বললেন- কেমন?
-হেব্বি লাগছে।
– আমি ত ভয় পেয়ে গেছিলাম। ভাবছিলাম অন্য কিছু!
-আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করি?
-বাহব্বা, এত এত পারমিশন লাগে নাকি?
– ভয় লাগছে!
– আচ্ছা, ভয় নাই, বলো।
– আপনার ওই তিল টা কি অরিজিনাল?
-আজিব, তিল কি আবার ডুপ্লিকেট হয় নাকি?
– না, এখন তো মানুষ অনেক কিছু লাগায়। তাই ভাবছি, আপনিও!
– বিশ্বাস না হলে টাচ করে দেখো।
– প্লিজ, এসব কি বলছেন! আমার হেব্বি লজ্জা লাগছে।
-হু, দেখেই ত বুঝা যাচ্ছে।
খেলা শেষের দিকে। আমার হার প্রায় নিশ্চিত। হাত দিয়ে গুটিগুলো আউলিয়ে বললাম-দেখছেন, আমি ইচ্ছে করেই হারলাম।
-‘তুমি আসলেই একটা বদের ডিব্বা!’
মেয়েটির কণ্ঠে উষ্মা ঝরল। বুঝলাম এই মেয়ে জীবনে একটা গালিই শিখেছে- বদ। বললাম, বদ ছাড়া আর কোন কোন শব্দ দিয়ে আপনি রাগ প্রকাশ করতে পারেন না? মেয়ে এবার লাজুক হেসে বলল, কি ভাব তুমি? আমি গালি পারি না? অনেক অনেক গালি পারি। বললাম, বেশ তাহলে চলেন ওই উন্মুক্ত মঞ্চে। এই দুপুরে ওখানে কোন লোক নেই। শুনব আপনার গালিবিতান। বলেই উঠে দাঁড়ালাম। দরজার কাছে গিয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখি মেয়েটা এখনো ওখানে বসে আছে। বললাম, কই উঠেন! অনিচ্ছার দড়ি টানতে টানতে উঠে দাঁড়ালো মেয়েটা।
তখন দুপুর দুইটা। খাওয়া হয়নি এখনো। জিজ্ঞেস করলাম, খেয়েছেন দুপুরে? আবারো বিভ্রান্ত হাসি দিয়ে বললেন-না, খাইনি। আজ আমার উপবাস চলছে।
-আপনি কি হিন্দু নাকি?
-নাহ! হিন্দু হতে যাব কেন?
-বা রে! মানুষ কি হিন্দু হতে পারে না?
-পারে। কিন্তু আমি হিন্দু না।
-তাহলে উপবাস করছেন কেন? ওটা তো হিন্দুরা করে।
-আমিও করি। মাঝে মাঝে মন খারাপ থাকলে উপবাস করি।
-রোজাই তো রাখতে পারেন।
-রোজা রাখলে তো সওয়াব হয়। তাতে লাভ আছে। কিন্তু উপবাসে সওয়াব নাই। আছে নিজেকে কষ্ট দেয়া।
-আপনি কি দুঃখবিলাসী?
-কিছুটা।
-তাহলে দুপুরে খাবেন না কিছু?
-নাহ, খাব না।
-ঠিক আছে আমিও খাব না।
-তুমি খাবে না কেন?
-ধরে নেন আপনার মন খারাপ বলে আমারও মন খারাপ!
আমরা দুপুর রোদে উন্মুক্ত মঞ্চের সিঁড়িতে বসে প্রথমে কিছুক্ষণ রোদ আর বাতাস খেলাম। মেয়েটা চুপ হয়ে বসে আছে। জিজ্ঞেস করলেন- তুমি কোন ইয়ারে পড়? বললাম, কেন? কিছু করবেন নাকি! ডান হাত দিয়ে কাঁধের উপর মৃদু একটা চড় দিয়ে বলল, খামখেয়ালি রাখ তো! কোন সাবজেক্টে কোন ইয়ারে পড়, বল! বললাম, আমাদের মাঝে এসব পরিচয় আর স্ট্যাটাসের বাঁধ আনতে চাচ্ছেন কেন, শুনি?
আমার মন খারাপ কেন শুনবে? মেয়েটার প্রশ্নে আগ্রহী হয়ে উঠলাম। বললাম, শুনব। বললেন- ছ্যাকা খেয়েছি। কত তম ছ্যাকা জানো? প্রশ্ন বোধক দৃষ্টি নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বলল, ষষ্ঠ ছ্যাকা। তখনি বেশ নাটকীয় ভঙ্গীতে উঠে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ করে বললাম, প্রণতি গ্রহণ করুন হে ছ্যাকাশ্বরী! মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বুকের উপর দুম দুম করে দুই হাতে গোটা আস্টেক কিল বসিয়ে দিয়ে বললেন- তুমি আসলেই খুব মজার! প্রশংসাটা লুফে নিয়ে বললাম, অথচ দেখেন এই মজার মানুষটাকেই আর আপনি গ্রহণ করতে পারবে না যখন জানবেন সে একজন ফুচকাওয়ালা! চোখ দুটো বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, সত্যিই তুমি ফুচকা বিক্রি করো? মেয়েদের নিয়ে এই এক বিপদ! কখন যে কি বিশ্বাস করে আর কখন যে কি অবিশ্বাস করে তা আগে থেকে বোঝা মুশকিল! কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর নিজ থেকেই বললেন-যাহ, তুমি ফুচকাওয়ালা হবে কেন? আমার কিন্তু ফুচকা খুবই পছন্দের।
-ছি: কি বলেন?
-ছি: বলছো কেন?
-ফুচকার টক কি পানি দিয়ে বানায় জানেন? একদম বস্তির ড্রেনের পানি দিয়ে।
-ও, আচ্ছা, এই পানি দিয়ে বানায় তাই কী স্বাদ বুচ্ছো। আর ভালো পানি দিয়ে বানালে কেমন স্বাদ হতো চিন্তা করছো?
-হইছে, তবে ফুচকার দোকানকে ফুলের বাগান মনে হয়।
– কেন, এমন মনে হয়?
– ওই যে মেয়েরা ফুল হয়ে আসে।
– তারপর!
-ছেলেরা মোমাচি হয়ে আসে।
-ডং ভালোই পারো, সত্যি তুমি ফুচকাওয়ালা?
– আচ্ছা বলেন তো, মানুষ আসলে কার সাথে বন্ধুত্ব করে? পরিচয় বা স্টাটাসের সাথে নাকি মৌলিক মানুষটির সাথে?
-আমার প্রতিটি রিলেশন ভেঙ্গেছে আমি ওদের চেয়ে ভাল স্টুডেন্ট বলে। এখন তুমিই বল, মানুষ আসলে কার সাথে রিলেশন করে? তবে অনেকদিন পর কারও সাথে মন খুলে এমন তৃপ্তি নিয়ে কথা বলছি। জানিস, খুব ভালো লাগছে রে।
-কী?
-তোর কথা।
-হুম, জানি। আমার কথারেই ভালো লাগে আমারে না!
এ কথা শোনার পর কিছুটা ইমোশনাল আর ডংগি হয়ে সাড়ে ঊনিশটা চুল দিয়ে ফেস ঢেকে ফেলছে। কিছুটা অভিমানের সুরে বলল- এই আমি তাকাতে পারছি না, দেখ তো চোখে কি হলো?
-আমি ক্যাম্নে বলব, কি হইছে?
– এটাই যদি না বুঝো, তাহলে তোমারে ভালো লাগলে কী হবে?
-প্লিজ, এমন ডং করবেন না। আমার কিন্তু হেব্বি লাগে।
-কেন?
-কারণ, ডং ছাড়া মেয়ে চিনি ছাড়া চায়ের মতো।
-এই, তুই এত্ত সুন্দর সুন্দর কথা কই পাছ রে? আরও ডং দেখবি, চল দেখাই।
মেয়েটাকে ভাল লেগে গেছে। উল্টাপাল্টা বলে এই মেয়ের সাথে সম্পর্কের ইতি এখানেই টানতে ইচ্ছে করল না। বললাম, একটা অনুরোধ রাখবেন? মেয়েটা বলল, কি? বললাম, রাখবেন কিনা বলেন? বলল, রাখার মত হলে রাখব। আমি বললাম- নাহ, এভাবে বললে তো অনুরোধ করব না। আপনি শর্তহীন ভাবে বলেন যে, রাখবেন। তাহলে বলব। কিছুক্ষণ ভেবে বলল, কিছু চাও? বললাম, অত ফাস্ট না আমি! আবার কিছুক্ষণ পর বললেন-আমাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যেতে চাও? বললাম, আপনি এত কমপ্লিকেটেড কেন? সোজা বাংলায় বলেন যে, রাখবেন। তখন ফিক করে হেসে বললেন-আচ্ছা বল, রাখব। বললাম, চলুন, দুজনে মিলে দুপুরের খাবারটা খেয়ে নিই। মেয়েটা উদাস চোখে তাকিয়ে বললেন- তোমার চাওয়া এত কম কেন? বেশ ডিপ্লোম্যাটিক ভংগীতে উত্তর দিলাম, নিজের চাওয়া নয় অপরের চাওয়ার গুরুত্বই আমার কাছে বেশি!
সেদিন পুরো বিকেলটা এক সাথে কাটালাম। থার্ড ইয়ারে পড়ে। বাংলা সাহিত্যে। নাম শারলিন। নিজের পরিচয় দিলাম, ইন্টারের পর ড্রপ আউট হওয়া ছেলে। গুলিস্তানে কাপড়ের ছোট ব্যবসা আছে সাথে ফুচকা বিক্রি করি। জিজ্ঞেস করেছিল, হকার? বললাম, হকারের মতই। তবে দোকান আছে একটা। মার্কেটের ভেতরে। দোকানের কার্ড চাইল। কিছুদিন আগে গেঞ্জি কিনেছিলাম যে দোকান থেকে সে কার্ডটা বের করে দিলাম। কার্ডের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি আজকে আমার এখানে থেকে যাও? বললাম, রাতের বেলা আপনার হলে আমাকে রাখতে পারবেন নাকি? এবার রেগে গিয়ে শারলিন বললেন- সিরিয়াস সময়ে মজা করো না তো!
-সিরিয়াস সময়ে মজা করলে চাপমুক্তি ঘটে। তাই মজাটা তখনই বেশি করতে হয়।
-চুপ কর তো! আমার কথার উত্তর দাও।
-ভাল ছাত্রী আপনি। ক্লাসে ফার্স্ট। সাময়িক মনকষ্ট আছ। আমার মত মজার একটা ছেলেকে পেয়ে ভাল লাগছে হয়ত। কিন্ত কিছুদিন পর মনে হতে পারে, এই ছেলে স্টাটাসের সাথে যায় না। তখন আরো বেশি কষ্ট পাবেন। সুতরাং এখন ভাল লাগছে ভাল লাগতে দেওয়াই ভালো। জীবনে এমন মুহূর্ত আসা ভালো। জীবনকে সামনে এগুতে সাহায্য করে। এই ভেবে আমাকে ধন্যবাদ দিতে পারেন যে- আমি আপনার মধ্যে একটা ভালো অনুভূতি সৃষ্টি করতে পেরেছি।
– সত্যিই রে, খুব ভালো একটা সময় পার করলাম।
– সাময়িক সময় ভালই কাটে কিন্তু স্থায়ি সময়ই কেমন কাটবে সেটা ভাবার বিষয়! এখন আমার সাথে সময়টা ভালো কাটছে। কিছু দিন পর অন্য একজনের সাথে। এই পৃথিবীর সবকিছুই আপেক্ষিক। তাই আমরা সবাই আপেক্ষিকতায় বিশ্বাসী হয়ে অভিনয় করি। কারণ চায়ে মাছি বসলে চা ফেলে দিই। আর ঘিয়ে মাছি বসলে মাছি ফেলে দিই।
-প্লিজ, আর কোন কথা শুনব না তোমার।
-কেন?
-যত শুনছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। এই মুগ্ধতা আমার জীবনে পেলে কেমন হবে?
-কোন ধরনের প্রমিজ দেয়া নেয়া থেকে বিরত থাকাই ভালো। এখান থেকে বেরুনোর পর, ভাল একটা জব নেয়ার পরও যদি মনে হয় এই ছেলেটাকেই আপনার চাই তখন না হয় এসব প্রমিজের দিকে এগুব আমরা!
-প্রথম দেখলাম কোন ফুচকাওয়ালার এমন জীবন দর্শন। এই তুমি কিন্তু সাহিত্য লিখতে পারো! তবে আমি আর পারছি না। জীবন নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছি।
-একচুয়েলি, জীবন হচ্ছে ক্লাস টু-এর বই এর মতো রিডিং পড়া যায় না বরং বানান করে পড়তে হয়।
-প্লিজ, আর না। আমি আর নিতে পারছি না। আমি সাহিত্যের স্টুডেন্ট হয়েও এমন জীবন দর্শন বুঝি নাই। আর তুমি। ক্যাম্নে শিখছো?
-পরিস্থিতি আমায় শিখিয়েছে।
-কেমন পরিস্থিতি?
-পরিস্থিতি বুঝানো যায় না। এটাকে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে উপলব্ধি করতে হয়।
-জীবনে অনেক কিছুই ঘটেছে। তার কোনটাই আমার ইচ্ছায় ছিল না সবই জীবনের ইচ্ছায়। সবাই সরে গেছে। অজুহাত দেখিয়েছে, আমি ভাল ছাত্রী। ওদের পাত্তা দিব না এই ভয়ে। অথচ ওদের কোন চাওয়াই অপূর্ণ রাখিনি আমি।
– সম্পর্ক কতক্ষণ টিকে জানেন?
-কতক্ষণ?
-যতক্ষণ একজন আরেকজনকে মূল্যবান মনে করে। নিজেকে সহজলভ্য করে তুলে নিজের মূল্য কমিয়ে ফেললে সে সম্পর্ক টিকবে কেন?
-কিন্তু সবাই তো করে এসব?
-যাদের এসব করতে দেখো তাদের সম্পর্কও আলটিমেটলি টিকে না। এখন হলে যাও। পড়তে বস। আত্ম-সম্মান নিয়ে বাঁচো।
– এই তুমি আমারে তুমি করে বললে ক্যান?
-কারণ টা অজানা। আমরা সবার কাছে ভালো হতে গিয়ে নিজের কাছে খারাপ হয়ে যাই। নিজেকে নিজে বুঝতে পারলে অন্যদের কাছে নিজেকে ব্যখ্যা করে বুঝানোর প্রয়োজন হয় না।
-আমি শুধু একটা বার তোমাকে বুঝতে চাই।
সেজান পয়েন্টে কফি খাওয়ার ঠিক ১ মিনিট ২৯ সেকেন্ড পর হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল- এই, কী ভাবছো এত্তক্ষণ। মন স্লো হওয়ার কারণ খুঁজে পেলে?
-সরি, আমি জাহাঙ্গীরনগর পুকুর পাড়ে শাড়ির দোকানে চলে গিয়েছিলাম।
-ক্যাম্নে?
-ভাবনায়।
-তাহলে পাইছো কারণটা?
হ্যাঁ, পেলাম।
-কী?
-সেখানে দাবা খেলার মতো আর কেউ থাকে না।
– হইছে, ডং বাদ দাও। তোমার দোকানে যাব, চল!
– কিসের দোকান?
-কেন তোমার না একটা কাপড়ের দোকান আছে? -ওসব এখন নাই।
-কি কর এখন তাহলে?
– একটা কলেজে ইংরেজি সাহিত্য পড়াই!
কথাটা শুনে মুখ হা হয়ে গেল! মিথ্যে বলেছিলে কেন তখন?
-তখন সত্য আর মিথ্যের মাঝামাঝি বলেছিলাম।
-আপনি কোথায় আছেন এখন?
-বাংলাদেশ পুলিশে। বিসিএস দিয়ে ঢুকেছি। শুনেই চোখ টিপি দিয়ে বললাম, এখন কি ইভ টিজিং এর দায়ে গ্রেফতার করবেন আমাকে? এক ফালি হাসি দিয়ে বললেন- তুমি আসলেই খুব মজার মানুষ। একটা কথা কি জানিস?
-কী?
-তোর সাথে দেখা হওয়া আমার জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট। তোর সেইদিনের কথা আর জীবন দর্শন আমার জীবন পরিবর্তনে খুব সাহায্য করেছে। আর কখনোই জীবন টাকে রিডিং পড়তে যায়নি। বরং বানান করে পড়তে পড়তে আজ পুলিশ ক্যাডার। সবচেয়ে বড় কথা নিজের কাছে নিজে ভালো হয়েছি। নিজেকে অন্যের কাছে ব্যাখ্যা করা ছেড়ে দিয়েছি। অন্যের মাঝে নিজের খুশি হওয়ার কারণ খুঁজি না। অনেক চেষ্টা করেছি তোর সাথে যোগাযোগ করার কিন্তু কোন অপশন পাই নাই। আমি সরি বললে তুই কি রাগ করবি?
– সবার মুখে সরি মানায় না।
শিতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে খাবারের অর্ডার দিলাম। সেদিন যা বলেছিলেন এখন কি তাই করবেন? হাসিতে মুখ উজ্জ্বল করে বললেন- না রে, আল্লাহ বেশ ভাল রেখেছে। হাজবেন্ড বেশ ভাল মানুষ। এক ছেলে এক মেয়ে। পুলিশের জব হলেও বর্তমান পোস্টিংটা মোটামুটি আরামেরই আছে। ওসব কথা এখন মাথায়ও আসে না। তারপর জিজ্ঞেস করলেন- তোমার খবর বলো!
-খবর আর কি? খাই, দাই ঘুরি ফিরি। আর কী?
হঠাৎ মোবাইল বেঁজে উঠল। ফোন কানে ধরে কিছু শুনল। তারপর বলল, স্যরি রে, এখনি উঠতে হচ্ছে। বসের সাথে একটা দরকারে এসেছি এদিকে। বসের কাজ শেষ। আমাকে এক্ষুণি নামতে হবে। পরে তোর সাথে যোগাযোগ করব। একটা কার্ড হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ফোন করিস। তারপর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল। একা একা বসে জীবনের সমীকরণ মেলাচ্ছি। হঠাৎ মনে হলো আমার তো জীবনের সমীকরণই নাই। সমীকরণ কঠিন হলে মেলানো যায় কিন্তু না থাকলে কি মেলানো যায়? প্রায় আধা ঘন্টা পর ওয়েটারকে ডেকে বললাম- আচ্ছা, জীবনটা কী রে?
-স্যার, আমাকে এই প্রশ্ন করছেন ক্যান? আমি কি এত্ত কিছু বুঝি নাকি? তবে আমার কাছে জীবন মানে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই না।
– তুই মরবি কবে?
-স্যার, কি লাগবে বলেন? আপনার এসব আজগুবি প্রশ্নের উত্তর জানা নাই।
-এসি টা আরেকটু কমিয়ে দেওয়া যায় না? খুব গরম লাগছে।
-স্যার, ১৬ তে আছে আর কমানো যাবে না। স্যার, আপনি ত অনেক ঘামছেন। টিস্যু দিয়ে কপালের ঘামটা মুছুন।
-ওকে। ঠান্ডা পানির মধ্যে আইস কিউব দিতে পারবি?
এটা বলতেই আমার পিছনে পুলিশের ড্রেসে শারলিন। মায়াবী দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছে। কিন্ত পারছে না। কথা আড়িয়ে যাচ্ছে। ওয়েটারের কাছে থেকে টিস্যু নিয়ে কপালে বাম হাত দিয়ে আমার চুলগুলো উপরের দিকে ভাঁজ করে ধরে রাখলো। আর ডান হাতের টিস্যু দিয়ে আমার কপালের ঘাম মুছে দিচ্ছে। মুখটা কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বললেন- এই ঘামের মধ্যে আইস কিউব দিয়ে ঠান্ডা পানি খাওয়া ঠিক হবে না।
এরই মধ্যে কয়েকজন পুলিশ ফোর্স উপস্থিত। হঠাৎ রাগান্বিত হয়ে বললেন- খবরদার, আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবি না।
আমি কিছুটা হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- ক্যান?
-কোন কথা না। চুপ, একদম চুপ। ইউ আর আন্ডার এরেস্ট!
লেখক: মালেক ইকবাল, প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।