হঠাৎ মেসেজ রিকুয়েষ্ট। অনেক লেখা, শর্টে বলি।
আসালামুয়ালাইকুম, আপনার লেখা দারুণ লাগে। এত সিম্পল কিছু, এত্ত অসাধারণভাবে ক্যাম্নে লিখেন। ওয়াও। রিয়েলি জস লেখার হাত। আচ্ছা, আপনার লেখা কিছু গল্পের নাম আছে, ওইগুলা একটু ক্যামন না? সিনেমন আইস্ক্রিম, পদ্মাবতী এক্সপ্রেস, হাফ গোমটা, আইস কিউব-এসব নাম কোথায় পান?হেড ফোন এবং এক কাপ চা গল্পে তিল আবিষ্কারের বিষয়টা আমার কাছে হেব্বি লাগছে কিন্তু। এখনো মনে পড়লে বিশ্বাস হয় না। আপনি ক্যাম্নে এত্ত সুন্দর করে বর্ণনা করেন। যেমন- “শীতে ঠোঁটে ঠোঁট ধাক্কা খাচ্ছে। সেই শব্দ আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। তার গাল বেয়ে বৃষ্টির পানি চুয়েচুয়ে পড়ছে। স্কিনটা এত সফট যে চামড়ার নিচে কালো নীলচে রঙের দাগ দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। ঠোঁটের কোণায় পানির একটি বিন্দু লেপ্টে আছে। সেটা বাতাসে উড়ে যেতেই সেখানে একটি ছোট্ট তিল আবিস্কার করলাম।”
আরেকটা কথা, আইস কিউব গল্পে তিল আর টিপের দূরত্ব সত্যই ১৩.৬৭ ছিল? আমারও কিন্তু তিল আছে। বিশ্বাস করেন, আমিও চেষ্টা করেছি মাপার। প্রথমা, অজানা, পল্লবী আরও কি কি যেন নাম আছে, এখনও কি এদের সাথে যোগাযোগ হয়? শ্যাম্পু, পারফিউম এবং টুথপেষ্ট এসবের নাম কই পান? বিশ্বাস করেন, আমি জীবনেও এমন নাম শুনি নাই। আচ্ছা, আপনার গল্প এমনভাবে শেষ হয় কেন? যাই হোক, সব গল্পের ২য় অংশ লিখবেন কিন্তু সময় পেলে! দুই দিন পর সিন করে রিপ্লাই দিলাম- ok. উত্তর দিল- আপনি, আজিব মানুষ তো। আমি এত্ত এত্ত কিছু বললাম। আর আপনি শুধু Ok লিখলেন। এইটা কিছু হইলো? আচ্ছা, পদ্মাবতী এক্সপ্রেস গল্পের মত কয়েকটা লাইন আমাকে নিয়ে লিখেন না, প্লিজ। আমি আড়াই দিন পর লিখে দিলাম– “সম্ভব হইলে আমারে বিক্রি কইরা তোমারে কিনতাম।”
কিছুক্ষণ পর দেখি শুধু এই লাইনের স্ক্রিনশট তার মাই স্টোরি তে। আমি সিন না করে শুধু দেখে রেখে দিলাম। কিছু আর বললাম না। ঠিক ২৯ মিনিট পর আমাকে মেসেজ দিল। এইবার যা লিখলো! কি আর বলবো? তারপরও বলি- আপনি তো আজিব মানুষ! আপনি কেন বারবার মেসেজ দেন? আপনাকে কয়বার নিষেধ করতে হয়? আপ্নি কি কথা বুঝেন না? আবার বলেন, আপনারে বিক্রি করে আমাকে কিনবেন? এইটা কেমন কথা? আর একবার মেসেজ দিলে কিন্তু ব্লক খাবেন। কিছুক্ষণ পর দেখি এটাও তার মাই স্টোরিতে। এটা পড়ার পর আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। কি বলব, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না! শুধু লিখলাম- r u ok? প্রায় ২ ঘন্টা ৩৯ মিনিট পর উত্তর দিছে- এক্সট্রেম্লি সরি, প্লিজ কিছু মনে করবেন না। তাকে রাগানোর জন্য আপনাকে দিয়ে এমন কিছু লেখায় আমি মাই স্টোরি দিছি! তবে আপনার লেখার ধরণ দারুণ। ইশ! যদি এমন গল্পের পল্লবীর মতো ক্যারেক্টার হতে পারতাম!
মেয়েটা প্রায় ১ বছর ৯ মাস পর মেসেজ দিল। এইবার সরাসরি তুমি।
-জব পাইছ নাকি শুধু গল্পই লিখো?
-না।
-আমার বিয়ে ঠিক হইছে।
-ওহ্! কনগ্রেইটস!
-আমায় নিয়ে পালাতে পারবা?
-না।
-ওকে। তোমার ঠিকানাটা বলো। ইনভাইটেশন কার্ড পাঠিয়ে দিব। বিয়ে-খাইতে আইসো কিন্তু। তেমন কিছু না লিখে শুধু লিখলাম-Ok
দুইদিন পর রঙিন কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট আসল ক্যুরিয়ারে। রাতের বেলায় দেখি মেসেঞ্জারে ইয়া বড় টেক্সট- তুমি খুব সুন্দর খারাপ! যাইহোক, বাবার পছন্দের ছেলেটা অনেক বড় চাকরি করে। ম্যালা বেতন! অনেক স্মার্ট। তোমার থেকে মাশাল্লাহ দেখতে সুন্দর! মাথায় অবশ্য তোমার মত এলোমেলো চুল নেই। তোমার মতো টানা টানা চোখ আর জোড়া ভ্রু নেই। তার সামান্য টাক আছে। তবে খুব গোছালো। আমাকে আশ্বাস দিয়েছে, খুব আদরে রাখবে। আশীর্বাদে আমায় গয়নায় মুড়িয়ে দেবে। আমাকে সে রাণী করে রাখবে। তার বাড়িতে কোন কাজ করতে হবে না আমাকে। ধুর! খালি ওকে নিয়ে বকবক করে যাচ্ছি। আচ্ছা, তুমি কি সেই গল্পটা লিখে শেষ করেছ? যে গল্পের আমি একটা ক্যারেক্টর হতে চেয়েছিলাম। নাকি আমার পাত্তা না পেয়ে সে গল্পটা লেখা ছেড়েই দিয়েছ? এবার গল্পটা কিন্তু অবশ্যই লিখবা। একটা আবদার। জানি, তোমাকে আবদার করার মত কোনো অধিকার আমার নেই, তবুও করছি। যদি পারো, আমার বিয়েতে একটা সিঁদুরের কাঁটা গিফট করো আমায়। অল্প দাম দিয়ে কিনো। তোমার হাতে সিঁদুর পরাটা আমার কপালে ছিল না হয়ত। কিন্তু তোমার দেয়া কাঁটায় সিঁদুর আাঁকতে তোমার নিশ্চয় আপত্তি থাকবে না!
পড়ে খুব আশ্চর্যান্বিত হলাম। একদিকে ভালোও লাগল। আমার মত উজবুককে কোনো মেয়ে সত্যিই আপন করে চেয়েছিলো? আমি নির্দিষ্ট দিনে গিয়ে হাজির হলাম। মানুষে মানুষে জমজমাট আবহাওয়া। সবাই খুব ব্যস্ত। এত ব্যস্ততার ভীড়ে কৃত্তিকা কে কোথাও দেখতে পেলাম না। উঠোনের এক মাথায় বসে আছে। একটা কম বয়সী মেয়ে বরকে পাখার বাতাস করছে। আমি বরকে গিয়ে বললাম, আপনার ওখানে টোপর পরে আমার বসে থাকার কথা ছিল।
বর হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল, কে আপনি? আর এসব কথাই বা বলার সাহস আপনার কী করে হয়?
আমি শান্তভাবে বললাম, আপনি যে মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন ঐ মেয়েটা আমাকে নিয়ে পালাতে চেয়েছিল। আমি পালাই নি। এবার আপনিই ভেবে দেখুন। কেন সাহস পেলাম।
বর তেলেবেগুনে উঠে এসে আমার কলার ধরে নিয়ে গেল একটা ফাঁকা রুমে। একরকম হুলস্থুল বেঁধে গেল উঠোন জুড়ে। একটু পর মেয়ের বাপ আসল রুমে। উনার অগ্নিমূর্তিতে বাপ-বাপ ভাবই ছিল। তাই বুঝলাম উনিই বাপ। উনি বললেন-তুমি আমার মেয়েকে চাও?
-কেন?
-আমার মেয়ে কি তোমাকে চায়?
-জানিনা। কিন্তু আপনি ওর বিয়ে ঠিক করলেও আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করেছিল। আমি না বলেছিলাম।
-তুমি কী করো?
-আপাতত একটা গল্প লেখার চেষ্টা করতেছি।
-খুব বড় লেখক! তা সারাজীবন কি আমার মেয়েকে গল্পই খাওয়াবে?
-না, মাঝে মাঝে কবিতাও শুনাবো।
-তুমি ত আচ্ছা বেয়াদব ছেলে! এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাও..এই বলে কয়েকজন লোক দ্বারা আমায় কুত্তার মত তাড়িয়ে রাস্তায় বের করে দিল।
হঠাৎ ঘেউ-ঘেউ শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। যাক, স্বপ্ন ছিল তাহলে!
সকাল সকাল সেজেগুজে রেডি হয়ে রওনা দিলাম। মনের ভিতর একটা অন্যরকম উদ্দীপনা চলছে। গোধূলীতে পৌঁছালাম। রাস্তা থেকেই ঝলমলে পরিবেশ। গেইটের উপরে খুব সুন্দর করে জরি দিয়ে লিখা “টুডে কৃত্তিকা’স ওয়ে’ডিং”। দুপাশের ছোটছোট মিউজিক বাল্বের মধ্য দিয়ে হেঁটে উঠোনে গিয়ে পৌঁছালাম।
মানুষের কোন ব্যস্ততা নেই। কেমন শান্ত পরিবেশ। বরাসনে টেকো মাথার বর কই? এখনো পৌঁছে পারিনি বোধ হয়। কেবল সূচিকর্ম দ্বারা অলংকৃত সাদা কাঁথার উপর কয়েকটা নতুন বালিশ পড়ে আছে। উঠোনের মাঝখানে বানানো গোলাকৃতির ছাঁদনাতলা। ছাঁদনাতলায় সাদা পিটুলির উপর লাল জবার আলপনা আঁকানো। দুটো কলসি, কলসির উপর আমের পল্লব আর দুটো কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি পাশাপাশি। একজন বুড়ো ব্রাহ্মণ গায়ে গামছা পরে মুখে হাত দিয়ে বসে আছে। উঠোনে আরো দু’চারিজন লোক এদিকে ওদিকে। উত্তর দিকে একতলা বড় পাকা বাড়ি। অনেকগুলো রুম। একটা রুমে কিছু মানুষের শোরগোল মনে হলো। একটু এগিয়ে যেতেই মহিলার কান্নার স্বর শুনতে পেলাম। আমি দরজা দিয়ে ঢুকতেই একজন বলল, এই বোধহয় সেই ছেলেটি। দেখলাম কৃতিকা শুয়ে আছে মেহগনির পালঙ্কে। লাল বেনারসি শাড়ি পরে কেমন-সুন্দর বউ সেজেছে আজ। দুহাতে লাল চুড়ির ‘পরে দুজোড়া সাদা শাঁখা। ওঁর কপালখানি খালি। প্রফুল্ল শ্যামল মুখখানি কেমন স্নিগ্ধ শীতল মলিন। মনে মনে ভাবছি এই মেয়েকেই ছোট্ট বেলায় মানুষ পূজা করতো।
কেউ একজন এসে বলল, কৃত্তিকা আপনাকে এখান থেকে এক্ষুণি চলে যেতে বলেছে। আর বাসায় পৌছার পর মেসেঞ্জার চেক করতে বলেছে। প্লিজ, আপনি কিছু মনে করবেন না, চলে যান।
হতভম্ব হয়ে বাসায় আসলাম। মনটা আনমনে। ভালো লাগার কোন কারণই খুঁজে পাচ্ছি না। বালিশের উপর হাত তার উপর থুতনি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। মোবাইল ফোনে Wifi কানেক্ট হতেই মেসেঞ্জারে টুং টাং শব্দ। মেসেঞ্জার ওপেন করতে দেখি ইয়া বড় একটা মেসেজ।
তুমি এসেছো? আমি জানতাম তুমি আসবে। তুমি না এসে পারবেই না। তোমার ব্যক্তিত্বের প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাস ছিলো। বড় চাকরিওয়ালা পাত্র না দেখে অবাক হয়েছ? তুমি জান না, আমি এক ছন্নছাড়াকে খুব করে চেয়েছিলাম। তার প্রতিটা গল্পের প্রতিটা ক্যারেক্টর আমার মুখস্থ। যখন তার গল্প পড়তাম, নিজেকে ওইসব ক্যারেক্টারে কল্পনায় করতাম। জানো, খুব হিংসে হতো। মনে মনে ভাবতাম, ইশ, আমি যদি এমন কোন গল্পের ক্যারেক্টর হতে পারতাম। দিল্লি স্ট্রিট এন্ড সিনেম্যন আইস্ক্রিম গল্পের শীতের মধ্যে গরম মাপার কথা মনে হলে এখনো আমার শরীরে গরম অনুভব হয়। আইস কিউব এবং একটা চিরকুট গল্পের ওড়নার সুতা বের করে টিপ আর তিলের দূরত্ব মাপাটা আমার ভাবনাটাকে আরও শক্তিশালী করেছিল। আমিও মনের অজান্তে অনেক বার মেপেছি। কারণ আমারও তিল আছে, তবে তার পছন্দের জায়গায় না। এজন্য ভয় হতো। যদি তার পছন্দ না হয়। অন্য একটা কারণে তাকে নিয়ে খুব ভয় হতো। তার জীবনে এত্ত এত্ত ক্যারেক্টর, তাহলে তার ক্যারেক্টর ক্যামন ছিলো। তবে একটা কথা কি জানো! সে অনেক ভালো মনের মানুষ ছিলো। এত্ত হাসিখুশি মানুষ আমি কখনও দেখি নাই। তার কাছে গিয়ে মন খারাপ করে থাকব, সেটা কখনই থাকতে পারতাম না। তার ব্যাক্তিত্বের মায়ায় পড়েছিলাম। এসব আগে বলিনি বলে রাগ করছ? প্লিজ, রাগ কইরো না। রাগলে অনেক ভয় লাগত। তার রাগের মধ্যে একটা আর্ট ছিল। এসব না বলার দ্বিতীয় কারণটা হল- তার আর আমার মাঝে একটা ধর্মের দূরত্ব ছিল। সেটা কারো পক্ষেই অতিক্রম করা সম্ভব ছিল না। অতিক্রম করেইবা কী লাভ ছিলো, বলো। আমার যে ক্যান্সার ছিল! কী করে বলতাম বলো! আমি তাকে কল্পনায় নিজের করে রাখতাম। বলিনি কারণ, বলে যদি না পেতাম। কই, গল্পটা এনেছ? আজ খুব শুনতে ইচ্ছে করছে। পাশে বসে একবার শুনাও না? শোনো, ওরা একটু পর আমাকে স্নান করাতে নিয়ে যাবে। স্নানের শেষে আমার সিঁথিতে সিঁদুরের ফোঁটাটা দিয়ে দিও, প্লিজ।