মালেক ইকবাল।।
এবারের ঈদটা একটু বেশিই স্পেশাল। তাই থাইল্যান্ড না গিয়ে কুরবানি ঈদের কিছু দিন আগেই বাড়িতে আসছি। না বাড়িতে ইচ্ছে করে আসি নাই, বারবার ফোনের কারণে আসতে হয়েছে। রাতে ড্রয়িং রুমে বসে মোবাইলে মিনিমালিজম সম্পর্কে পড়ছি। কিছুক্ষণ আগে প্রথমা শেষ বারের মত এই লিংকটা পড়ার জন্য পাঠিয়েছে, তাই পড়ছি। মাঝেমাঝে কয়েকজন মেহেদী রাঙা হাতের পিক পাঠিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। এদের মধ্যে পল্লবী বায়না ধরছে মাই স্টোরি দিতে হবে, দিলাম। তার আগে খান সাবের একটা ভিডিও ডিলিট করতে হয়েছে। বাচ্চারা স্পিকারে পছন্দের সাস সং একটু জোড়েই বাজাচ্ছে। পাশের রুমে আব্বা-আম্মা কোনো একটা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলাপ করতেছিলেন। কানে হেডফোন থাকায় প্রথম দিকে বুঝতে পারিনি কীসের আলাপ চলছে? এরই মধ্যে চাঁদনী মেহেদী রাঙা হাতের পিক মেসেঞ্জারে দিয়ে জিজ্ঞেস করছে- প্লিজ, বলেন না, কেমন হইছে ডিজাইনটা?  উত্তরে বললাম- ওয়াও, খুব সুন্দর খারাপ! উত্তরে একটা ইমজি দিল। এরপর আমি বললাম- ইমজি আমি বুঝি না। পরে হেডফোন খুলতেই তাদের ভাসাভাসা কথাগুলো কানে আসলো। আলাপ শুনেই বুঝলাম— বিয়ের আলাপ চলছে। কার বিয়ে? অবশ্যই আমার। এই বাড়িতে বিবাহ উপযুক্ত মানুষ বলতে আমি ছাড়া আর কেউ নাই।

আব্বা আম্মাকে বলছেন— এই নিয়ে তো তিনটা দেখা হলো। কাল যেটা দেখলাম, আমার ভালোই লেগেছে। দেখতে সুন্দর। হাইটও ভালো আছে। দেখলে তোমারও পছন্দ হবে। তোমার ছেলেকে বলো কাল গিয়ে সেও একবার দেখে আসুক। ওদের সাথে কথা হয়েছে। ছেলের পছন্দ হলেই ফোনে ফাইনাল করবো। বাড়িতে আমার বিয়ের আলাপ চলছে—ভাবতেই মনের মধ্যে একটা বিশাল লাড্ডু ফুটে গেল। ছুটিতে বাড়ি আসার পূর্বে আম্মা অবশ্য বিয়ের বিষয়ে হালকা রিকুয়েষ্ট পেয়েছিল। আম্মা তখন রাজি হননি। ফোনে বলেছিলেন- বিয়েশাদি সব পড়াশোনা শেষ করে চাকরি-বাকরি পাওয়ার পর। তারপরও এই সেপ্টেম্বরে ডেনমার্ক যাওয়ার কথা ছিল। সেটাও গেল না। শুধু দেশের ডিগ্রি থাকলে হয় নাকি, বিদেশরও লাগে। এসবের আগে বাড়িতে কোনো বিয়েশাদি নাই। কিন্তু বাড়িতে এসে মনে হচ্ছে আব্বা-আম্মার মন গলেছে। তাই পাত্রী দেখাও শুরু হয়েছে।

যাই হোক, আমি চাচ্ছিলাম, বিয়ে বিষয়ে তারা যেন আমার সাথেই সরাসরি আলাপ করে। তাই পাওয়ার ব্যাংক খুঁজে না পাওয়ার বাহানা দিয়ে সরাসরি তাদের রুমে ঢুকে পড়লাম। আম্মা আমাকে দেখেই বুঝতে পারলেন, আমি বাইরে থেকে তাদের সব কথা শুনতে পেয়েছি। তাই কোনো রাখঢাক না করেই বললেন, তোমার আব্বা তো দেখে এসেছে। পছন্দও হয়েছে। তুমিও  কাল একবার গিয়ে দেখে আসো। তিনটার মধ্যে যেটা তোর পছন্দ হবে সেইটাকেই বাড়িতে নিয়ে আসব। আমার ইচ্ছে হলো এক্সাইটমেন্টের ঠেলায় আব্বা-আম্মার সামনেই একটা জোরে লাফ দিই। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বললাম- তোমাদের পছন্দ হইলে আমার আর দেখার প্রয়োজন কী! তোমাদের পছন্দ-ই আমার পছন্দ। কিন্তু তারপরও যখন বলছো, ঠিক আছে সমস্যা নাই। কাল গিয়ে দেখে আসবো।

পাত্রী দেখতে যাব, এই বিষয়টা মনের ভিতর ঢুকার পর থেকেই আমার মনের মধ্যে উথালপাথাল শুরু হয়ে গেল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে খালি ভাবতেছি— মেয়ে দেখতে কেমন হবে? কার মতো হবে দেখতে – প্রথমা, পল্লবী, পদ্মাবতী, চাঁদনী, মধুবালা, কৃত্তিকা, শারলিন, নিদ্রা? যার মত হোক না কেন? দূর থেকে গালের নীলচে রগ দেখা গেলেই হলো। ছোট্ট কালো তিলের কথা আর কী বলব? কিন্তু সিনেমন আইস্ক্রিম, কানাডার জয়কো শ্যাম্পু, নরওয়ের এভার মার্টিন ব্রান্ডের লায়লা পারফিউম, দিল্লি স্ট্রিট, দার্জিলিং এসব যদি পছন্দ না করে, তখন কী হবে? এসব ভাবনা ভাবতে ভাবতে রাতে একসময় ঘুমের দেবীর আগমন!  ঘুমের মধ্যে হঠাৎ মেসেঞ্জার ওপেন হতেই দেখি প্রায় ৪৯ টা মেসেজ। সর্বশেষ মেসেজটি ইমা দিয়ে জিজ্ঞেস করছে-  কার হাতের পিক মাই স্টোরি দিছেন?
– আরে তোমার স্টোরি কেন দিতে যাব? আমি তো আমার স্টোরি দিছি।
উত্তরে ‘অহ’ ছাড়া আর কিছু লিখে নাই। ঠিক ১ মিনিট ২৯ সেকেন্ড পর লিখছে- আপনার ছাদ বাগানের  কয়েকটা সাদা গোলাপ ফুল এই ঈদে দিতে চেয়েছিলেন।
– সাদা গোলাপ, তাও আবার কয়েকটা!
– প্লিজ, না করবেন না! আমি ফ্রেশওয়াশ বানাবো।
– ওকে, তবে আসার সময় কয়েকটা আইস কিউব আনতে হবে কিন্তু।
– কেন, বড়আম্মু তো বলছে আপনি আর আইস কিউব খান না। আর কেউ যদি দেখে ফেলে?
-কেউ দেখে ফেললে সেটা না দেখলেই হয়। আরেকটা কথা আগামীকাল ঠিক পড়ন্ত বিকালে সূর্য যখন  ৪৫ ডিগ্রি কোণে সাদা গোলাপ গাছের উপর কিরণ দিবে, তখন আসতে হবে। সাথে ওই একটু সাদা মিষ্টি কালারের ড্রেসটা। কারণ এ ড্রেসে মাঝে মাঝে তার মধ্যে এমা ওয়াটসনকে এবং এম্মা স্টোন দুজনকে এক সাথে খুঁজে পাই। কী সুন্দর হালকা পাতলা ছিপছিপে গড়নের। দেখলেই তাকে বলি তুমি ত গরিবের এমা এম্মা ওয়াটসন। তার Crazy Stupid Love মুভি দেখে একবার ভুল করে স্বপ্নে দেখেছিলাম। একবার আমার খুব জ্বর। কিছুতেই যাচ্ছে না। পরে বাজারের এক আংকেল ডক্টরের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি প্রেসক্রিপশনে লিখেছিলেন- নাপা এক্সটেন্ড তিন বেলা অথবা খাওয়ার পর ইমার সাথে তিন বেলা ৮.৯ সেকেন্ড করে চ্যাট। আংকেল বিষয়টা জানতো কি না, কে জানে? তাছাড়া এটা ক্যাম্নে লিখলো? যাই হোক, আজকেও একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাব। দেখি স্বপ্নের বাকি অংশ আজকে আবার দেখা যায় কি না?

পরদিন সকাল নয়টার দিকে আমার ঘুম ভাঙলো। দ্রুত নাস্তা সেরে সাজগোজ করে রেডি হয়ে নিলাম পাত্রী দেখতে যাব বলে। পাত্রী দেখতে যাব, কিন্তু ওয়ালেটে খুব বেশি টাকা নেই। জীবনে প্রথমবার দেখতে যাচ্ছি। কেমন কি লাগবে সেটাও আইডিয়া নেই। ঈদে বাড়ি আসার সময় প্রতিবারই কয়েকটা চকচকে নতুন টাকার বান্ডিল নিয়ে আসি। সেগুলাসহ সব টাকা আম্মার কাছেই রাখি।  তাই আম্মার কাছে গেলাম টাকা চাইতে । সাথে মেয়ের বাসার ঠিকানা আর ফোন নাম্বারটাও নিয়ে নিতে হবে।

আম্মাকে গিয়ে বললাম— পাত্রী দেখতে যাচ্ছি, খালি হাতে তো আর যাওয়া যায় না। কিছু টাকা পয়সা দাও। বাজার থেকে কয়েক কেজি মিষ্টি কিনে নিব। আর বাসার ঠিকানাটাও দিয়ে দাও। আরও জানতে চাইলাম- মেয়েটার কি তিল আছে? আমার কথা শুনে আম্মা হঠাৎ হোঁ হোঁ করে হেসে উঠলেন। আমি বুঝতে পারলাম না, এই অট্টাহাসির কারণ কী! জিজ্ঞেস করলাম— কী সমস্যা তোমার? হাসছো কেনো?
আম্মার হাসি কোনোমতেই থামছে না। হাসি শুনে পাশের রুম থেকে আব্বা চলে এলেন। আব্বার সামনেও আম্মা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিচ্ছে।
আব্বা জিজ্ঞেস করলেন, ঘটনা কী? কী হইছে? আম্মা কোনোমতে হাসি থামিয়ে আব্বাকে বললেন, তোমার ছেলে পাত্রী দেখতে যাচ্ছে। তারে কিছু টাকা-পয়সা দাও। মেয়ের বাড়ি মিষ্টি নিয়ে যাবে।

এই কথা শুনার পর আব্বা আমার দিকে কিছুক্ষণ ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হাসতে হাসতে বললেন— “ওরে, গাঁধার বাচ্চা! তোরে আমি কুরবানির জন্য গরু দেখতে যাইতে বলেছিলাম, বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে না। গত বছর গরুর গায়ের রঙ তোর পছন্দ হয় নাই বলে ঘ্যানঘ্যান করছিলি, তাই এইবার তোরেই গরু দেখতে পাঠাইতেছি যাতে দেইখা শুইনা তোর পছন্দ মতোই গরুটা কিনতে পারিস।”

লেখক- প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *