মালেক ইকবাল।।
জ্যোতিষ শাস্ত্রের ওপর আমার কখনোই বিশ্বাস ছিল না। এখনও নেই। একজন জ্যোতিষী একদম নিচের স্লিপার বেডে শুয়ে আছেন। তাঁর পাশে আমি প্রায় ২৯ মিনিট ধরে বসা। আমার সিটটা মাঝখানে। তাই সেখানে বসার কোন উপায় নেই। লাগেজ এবং ব্যাগেজ দিয়ে ফ্লোর গাদাগাদি। উপরের দুইটা স্লিপার বেডে দুজন বসে আছেন। জ্যোতিষী মশাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- তার সাথে তোর কিসের সম্পর্ক? আমি চমকে উঠে বললাম- কই, না তো, তেমন কিছু না।
– না, আমি অনকেক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছি। তোদের দু’জনের মধ্যে কিছু একটা চলছে। দ্যাখ, মেয়েটাকে দেখে অনেক ভদ্র মনে হচ্ছে। তোর সাথে কিন্তু যাবে। ভবিষ্যৎ ভালো হবে। আমার বয়স কিন্তু ৮৯ বছর। অনেক ভেবে চিন্তেই বললাম। তোর মতো এরকম জোড়া ঘন ভ্রুর ছেলে তার মতো মেয়ের ভাগ্যকেও সুপ্রসন্ন করে। তুই যখন বাহিরে গিয়েছিলি, এই কথাগুলো তাকেও বলেছিলাম। উত্তরে মেয়েটা তেমন কিছু বলেনি। কিন্তু লজ্জায় একদম লাল হয়ে গিয়েছিল।আমার পাশে আর বসতেই পারলো না। উঠে তার সিটে গিয়ে বসলো। আর তুই আসলি। তুই কিন্তু ভেবে দেখতে পারিস। মেয়েটা প্রিয়ংবদা।

জ্যোতিষী মশাই এর কথায় বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। গল্পের মাঝে তার দিকে একবার লুকিয়ে তাকালাম। সরাসরি তাকানোর উপায় নেই। আশেপাশে অনেক মানুষ। সামনের স্লিপার বেডে আমাদের টিমের তিন / চার জন সিনিয়র বসে আছেন। কে কী ভাবে? কে জানে? উপরের বেডে সে একদম লজ্জাবতী মেয়ের মতো বসে আছে। আনমনা মন। কী যেন ভাবছে? হয়তো জ্যোতিষীর কথাগুলো ভাবছে। নিচের দিকে তাকাতেই আমার চোখে চোখ পড়লো। ইশারায় নিচে আসতে বললাম। সিটের লোহার হাতল ধরে আস্তে করে নিচে নামলেন। কোথায় বসবেন, ভেবে পাচ্ছেন না? এটা দেখে  জ্যোতিষী উঠে বসলেন। তিনিও আমার  সামনে জানালার পাশে বসলেন। সেই ৪৯ নম্বর কেবিনের ৯ টা সিটে প্রায় আমরা ১৫/২০ জন বসে আছি। যে যার মত গল্প করছেন। পদ্মাবতী এক্সপ্রেস তার আপন গতিতে চলছে। জানালা একদম বন্ধ। হাড় কাপানো শীত। একটা জানালা দিয়ে বাহিরের ঠান্ডা বাতাস আসছে। তার চুলগুলো সেই বাতাসে উড়ছে। কাস্মীরী চাদরটা টেনে ঘোমটা দিলেন। তিনি জ্যোতিষীর দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি তার দিকে চেয়ে আছি। এমন সময় জ্যোতিষী মশাই হঠাৎ আমাকে ছোট্ট করে ধাক্কা দিয়ে বললেন- আরে কী দেখিস, আগে জানালা টা ঠিক কর। দেখিস না, শীতে কাপছে। মাথার ঘোমটা টা হাফ করে বললেন- প্লিজ! আমি দেখছি। আপনার কষ্ট করতে হবে না। এটা শুনে জ্যোতিষী বললেন- কিরে, আমি বলেছিলাম না! 

জ্যোতিষী মশাইয়ের কথা মেলানোর চেষ্টা করছি। আঞ্চলিক হিন্দিতে বললে হয়তো বুঝতাম না এবং এত বিস্মিত হতাম না। জ্যোতিষীর বাড়ি বিহারে। খুব ভালো বাংলা বলতে পারেন। বাংলা সাহিত্যের উপর মন মাতানো দখল রয়েছে। আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- তাম্বুল রাতুল হইল অধর পরশে। এটার মানে কি? তিনি ব্যখ্যা করে বললেন- শোন, আলাওল তার পদ্মাবতী কাব্যগ্রন্থে পদ্মাবতীর রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে এই পঙক্তি ব্যবহার করেছেন। আমরা জানি, পান খেলে ঠোঁট লাল হয়। কিন্তু পদ্মাবতী তো আর যেই সেই রূপবতী ছিলনা! ছিল অপ্সরী, যার ঠোঁটের স্পর্শে পানই বরং লাল হয়ে যায়, রক্তবরণ পদ্ম জলান্তরে বসে লাজে মরে যায় পদ্মাবতীর রূপ দেখে! হায় পদ্মাবতী। আর তোর টা পদ্মাবতী না, একদম লজ্জাবতী। এটা শুনে তিনি ঠোঁটের এক কিনারে ৪৫ ডিগ্রি কোণে মুচকি হেসে উপরে চলে গেলেন। হঠাৎ আমার মেসেঞ্জার এ সাউণ্ড। ওপেন করতেই দেখলাম তিনি লিখেছেন- ভালোই শুরু করেছেন, না!

এত আনন্দের মাঝেও মনটা ভীষণ খারাপ। কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। হঠাৎ মনে হলো দেশে থাকতেই কয়েকটা মেসেজ এসেছিল। দেখার সুযোগ হয়নি। খুবই ব্যস্ত সময় পার করতে হচ্ছে। অনেক বড় দায়িত্ব নিয়ে এখানে আসতে হয়েছে।ট্রেনের দরজার হাতল ধরে দাঁড়িয়ে আছি। ঝকঝক করে ট্রেন চলছে। মনটা আরও গতিতে চলছে। মেসেজটা পড়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম। এটা কেমনে সম্ভব? এটা কিভাবে করলো?  একটা বার জানাতেও পারলো না। উপরের দিকে স্ক্রল করতেই দেখি কয়েক শত শব্দের অনেকগুলো মেসেজ। সময়ের কাছে হেরে গেলাম। শুধু নিজের ইমেজটা ঠিক রাখতে। কিছুই বলার বা করার নাই। সময়ের প্রয়োজনে অনেক সময় দায়িত্বই বড় হয়ে যায়। মনটা ভীষণ খারাপ। খেয়াল করে দেখলাম উপর থেকে তিনি আমাকে লক্ষ্য করছেন। ইশারায় আমার মেসেঞ্জার চেক করতে বলছেন। কিন্তু আমার ফোনে তো চার্জ নাই। ইশারায় এটা বুঝাতে পারলাম না।

হঠাৎ তার ফোনটা আমার হাতে দিয়ে বললেন – প্লিজ, একটু দেখবেন, আমার মেসেঞ্জার কাজ করছে না কেন? মেসেঞ্জার দেখে আমি তো অবাক। এই অল্প সময়ে আমাকে অনকে এসএমএস দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন- কি ব্যপার মেসেজ সিন করছেন না কেন? প্লিজ রিপ্লাই দেন। এখানে থেকে যাওয়ার পর আপনার মন খারাপ।  কি হয়েছে আপনার? সত্যি করে বলুন তো।  আমার কোন কথায় কি রাগ করেছেন? আমি সবার সামনে কিছু বলতে পারলাম না। তার মেসেঞ্জারে লিখে দিলাম- আরে, তেমন কিছু না। আমার ফোনে তো চার্জ নেই। কিভাবে সিন করবো? তার দিকে হাত বাড়িয়ে ফোন দিয়ে বললাম- এই যে ফোন নিন। আপনার মেসেঞ্জার ঠিক হয়েছে। ফোনটা নিয়ে মনোযোগ সহকারে পড়ছেন।  আর কি যেন ভাবছেন? হয়তো ভুল ধারণা টা ভাঙছে। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন টা আমার হাতে দিয়ে বলছেন – প্লিজ, একটু দেখুন। আবার মেসেঞ্জার কাজ করছে না। ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম তিনি লিখেছেন – প্লিজ, আপনার ফোন টা আমার কাছে দিন। আমার কাছে পাওয়ার ব্যাংক আছে। না হলে এইভাবে এক ফোনে, এক মেসেঞ্জারে সবার সামনে দু’জন কতক্ষন চ্যাট করবো? আর সবাই বিষয়টা কিভাবে নিবেন? আমিও মোবাইলটা তার হাতে দিলাম।

তার সাথে এমন হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। তিনি খুব অল্পদিনের পরিচিত। এখানে আসার আগে দু একবার কথা আর মেসেঞ্জারে চ্যাট হয়েছিল। ২৯ নভেম্বর তার জন্মদিন ছিল।  উইশ করতে পারি নাই। পরের দিন আমাকে মেসেজ করলেন- কী ব্যাপার, জন্মদিনে উইশ করলেন না যে? আর আমার গিফট কোথায়?  উত্তরে আমি বললাম- স্পেশাল গিফট দেরীতে নিতে হয়। কালকে যদি আসতে পারেন, তাহলে দিবো।
– আমি কালকে আসতে পারবো না। এজন্যেই আগামীকাল এর কথা বলছেন, তাই না?  যাই হোক, আমি কিন্তু বাহিরে যাচ্ছি শুধু আপনার জন্য। প্লিজ, একটু খেয়াল রাখবেন। থাকা এবং খাওয়া দাওয়া নিয়ে একটু সমস্যা আছে। স্পেশালি ভাত ছাড়া অন্যকিছু যেমন রুটি খেতে পারি না।
– আসলে এটা গ্রুপ ট্যুর তো, তেমন কিছু করার থাকে না। তারপরও আমি দেখবো। তার সাথে এইতো কথা। আর তেমন কিছু না।

এসব ভাবতেই তিনি ওপর থেকে নিচে নেমে আসলেন। মুখে কোন কথা নেই। শুধু আমার দিকে চেয়ে আছেন। সবার সামনে আমিও অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। তিনি বললেন- আমার পাওয়ার ব্যাংকে চার্জ নেই। এদিকে পাওয়ার পয়েন্ট কোথায়? তাকে পাওয়ার প্লাগের কাছে নিয়ে গেলাম। আসতে অনেক কষ্ট হয়েছে। বগিতে  অনেকেই গাদাগাদি করে শুয়ে আছেন। তাদের মাঝে মাঝে পা দিয়ে আসতে হইছে। ট্রেনের দরজা সামনে দু’জন দাঁড়িয়ে আছি। কারও মুখে কোন কথা নেই। দেখলাম তার মনটা খুবই খারাপ। প্রচন্ড শীত আর বাতাস। খুব কাছাকাছি এসে বললেন- একটা কথা জিজ্ঞেস করি, মাইন্ড করবেন না, প্লিজ। আমি কিন্তু ইচ্ছে করে দেখি নাই। আপনার ফোন ওপেন করতেই চন্দ্রা নামের একজন মেয়ের একটা মেসেজ এসেছে। মেয়েটা কে?
আমি বললাম- স্পেশাল কেউ না।
– তাহলে উনি লিখেছেন – কিছুক্ষণ পর আমার বিয়ে। দোয়া করবেন, প্লিজ। একটু অভিমান নিয়ে বললাম – কেন?  একজন মানুষ কি একজনের কাছে দোয়া চাইতে পারে না?
– ও, আচ্ছা। হুম, তা চাইতে পারে। সরি, আমাকে ভুল বুঝবেন না। ফোন চার্জ হওয়ার পর দুজনই ঘুমাতে গেলাম। তার স্লিপার বেড নম্বর ৩৭। তার পাশেই ৩৮ নম্বর খালি থাকায় একজন সিনিয়র  ওখানেই আমাকে থাকতে বললেন। নিচে সবাই আড্ডা দিচ্ছেন। কেউ গান করছেন আবার ৪ জন লুডু খেলছেন।

আমি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। আর উনি ঘুমিয়ে গেছেন। পাম্পিং বালিশ ফুলানোর চেষ্টা করছি। কিছুতেই পারছি না। আমার ফু এর শব্দে ঘুম থেকে উঠলেন। ঘুমের চোখে মুচকি হাসছেন। আমি কিছুটা লজ্জা পেলাম। এটা দেখে বললেন – আমার কাছে দিন। ফুলিয়ে দিচ্ছি। তারপর দু জনই কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। তিনি আমার বিপরীত দিকে মুখ করে শুয়ে আছেন।দেখলাম তার পায়ে দু একটা মশা লাগছে। ঘুমের ডিস্টার্ব হবে ভেবে ডাক দিলাম না। আমার মুখের উপর কম্বল দিয়ে মেসেঞ্জার চেক করছি। তাকে মেসেঞ্জারে লিখলাম- পায়ে মশা লাগছে, প্লিজ, কম্বল দিয়ে পা দুটা ঢেকে ঘুমান। কোন উত্তর পেলাম না। কিছুক্ষন পর কম্বল সড়িয়ে দেখলাম- আমার দিকে মুখ করে আছেন। চোখ দুটা হাল্কা বন্ধ করে ঘুমাচ্ছেন। চোখে মুখে ক্লান্তির কোন ছাপ নেই। ঘুমের মধ্যেও সেই হাফ ঘোমটা। এখনো নাক ফুড়ায় নি। তেমন কোন ভারী অলংকারও পরে নি। একদম নিষ্পাপের মূর্ত প্রতীক। কী মায়াবী লাগছে! মনে হচ্ছে জান্নাত থেকে কিছু দিনের জন্য ছুটি নিয়ে আসছে। হঠাৎ ট্রেনের ব্রেক। তার কপালের সাথে লোহার শিকলের ধাক্কা লাগার উপক্রম। আমার ডান হাতটা শিকলের উপর রাখতেই, তার কপাল এসে আমার হাতের ওপর পরলো।
চোখ দুটো খুলে হাল্কা হাসি দিয়ে পাশ ফিরে ঘুমালেন। এরই মধ্যে দেখি মেসেঞ্জারে লিখেছেন- আহারে, কী মায়া? মশার উপর হিংসে হচ্ছে নাকি?

ট্রেনের ঝাকুনিতে ঘুমিয়ে পরেছি। হঠাৎ আমার শরীরে ওপর একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। আস্তে করে হাত দিয়ে আমাকে ধাক্কা দিচ্ছেন। ঘুমের মাঝে চমকে উঠতেই বললেন- সরি, আপনাকে ডিস্টার্ব করা ঠিক হয়নি। কি করবো বলুন, আপনাকে ছাড়া এই বেদেনা খেতে ইচ্ছে করছে না। হাত দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললাম- ঠিক আছে। অনেক চেষ্টা করেও বেদেনা টা ভাঙতে পারছে না। তারপর আমাকে বললেন- আমার মাথায় চুলের ক্লিপ আছে। ওটা দিয়ে দাগ কাটলে সহজেই ভাঙা যাবে। চুলে থেকে ক্লিপ টা কিভাবে খুলবে ভেবে পাচ্ছেন না? এক হাতে মাত্র নেইল পালিশ নিছে আবার অন্য হাতে বেদেনা। কিছু না বলে আমার দিকে মাথা এগিয়ে দিচ্ছেন। আবার নিচের দিকে তাকাচ্ছেন। কেউ যদি দেখে ফেলে! ইশারায় কি যেন বললেন বুঝলাম না? হঠাৎ বললেন-  আচ্ছা আপনার হাত কি সাথে নেই? এইবার বুঝলাম। ক্লিপটা আমাকেই খুলতে হবে। রেবন্ডিং করা ঝলমলে আর সিল্কি চুল। তাতে আবার কানাডার Joico shampoo মাখা। সেই পরিচিত ফ্লেভার। যাই হোক ক্লিপ টা খুলতেই তার সাথে আড়াই টা চুল ছিড়ে গেলো। আড়াই টা মানে দুইটা বড় আর একটা ছোট। ব্যথা পেলেও দাতে কামড় দিয়ে কোন শব্দ করলেন না কারণ আশেপাশে সবাই  ঘুমাচ্ছেন। উনি এক হাত দিয়ে বেদেনা ধরে আছেন। আর আমি ক্লিপ দিয়ে চাপ দিতেই বেদেনাটা হাত থেকে ফস্কে জ্যোতিষী মশাইয়ের মুখের উপর পড়লো। তিনি চমকে উঠে চেচানো শুরু করলেন। উপরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- এই কাজ কে করলো? এটা শুনে তিনি অপরাধীর মতো কানে ধরে বিনয় প্রকাশ করলেন। এবার জ্যোতিষী মশাই মুচকি হেসে ঘুমিয়ে গেলেন। এসব দেখে একজন কলিগ আমাকে বললেন- ৪৯ নম্বর বেড ফাঁকা হয়েছে। আপনি সেখানে গিয়ে ঘুমাতে পারেন।

রাত প্রায় ১ঃ২৯ মিনিট। আমি ৪৯ নম্বর স্লিপার বেডে গভীর ঘুমে মগ্ন। হঠাৎ একজন আলতো ভাবে আমার পা স্পর্শ করছে। আমার পা টান দিতেই ওয়ান টাইম গ্লাসের পানি নিচে পড়ে গেছে। এটা নিয়ে ফ্লোরে শুয়ে থাকা মানুষ জন এক প্রকার সিন ক্রিয়েট করে ফেলছে। আমি ঘুম থেকে উঠে ব্যাপার টা বুঝিয়ে সরি বলে শান্ত করলাম। একটু বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- এইভাবে এখানে আসার দরকার কি ছিল? উনিও অভিমান নিয়ে বললেন- হুম, সেটাই তো। আমি যে শুনলাম আপনার খুব জ্বর। আপনার কপালে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। এই জন্যই তো পানি আর নাপা এক্সটেন্ড নিয়ে আসলাম। তারপর উপরের বেডে আমার পাশে বসলেন। জিজ্ঞেস করলাম- তাদের কি বুঝ দিয়ে এখানে আসলেন?
– কী আর বলবো? বললাম, আমার ফোনে চার্জ দিতে যাচ্ছি, আসতে একটু সময় লাগবে। আপনার এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। এইবার ওষুধ খেয়ে নেন। ওষুধ খাওয়ার পর বলছেন – আপনার বাম হাতটা দেখি।
– কেন?  বাম হাত দিয়ে কি হবে?
– আজিব, এত বেশি কথা বলেন কেনো? দিতে বলছি, দিবেন।
তার বাম হাত দিয়ে আমার আঙুল শক্ত করে ধরতেই আমি শিহরণে চমকে উঠলাম। তারপর নখে নেইল পালিশ দিতে শুরু করলেন। একদম মাথা নিচু করে গভীর মনোযোগের সাথে নেইল পালিশ দিয়ে দিচ্ছেন। তার সিল্কি চুলগুলো মাঝে মাঝে আমার হাতের ওপর পরছে।
– আরে এইসব কি শুরু করছেন?
– কি করবো, মেহেদি নাই তাই নেইল পালিশই দিতে হচ্ছে।

এরই মধ্যে নেইল পালিশ শক্ত হয়ে গেছে। তারপরও হাত ধরে বসে আছে। কিছু একটা বলতে চাচ্ছেন। মনে ভয় আর সংশয়। যদি তার মনের মতো না হয়! মাথা তুলে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বললেন- আচ্ছা, এইসব ঘটনা কি আপনার সাথে সত্যিই প্রথম? কোন উত্তর না দিয়ে শুধু তার চোখের দিকে চেয়ে রইলাম। আর বললাম- আপনার কি মনে হয়?
– আসলে আমার কিছুই মনে হচ্ছে না। মনে করেই বা কী লাভ। যা হওয়ার সেটাই তো হয়েই গেছে। তবে আপনার ক্লোজ দু একজন কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তারা অবশ্য বলেছেন- আপনাকে আগে কখনো তারা এমন দেখেনি। সেক্ষেত্রে বলতে পারি, এই প্রথম। কিছুটা সস্তি নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন- ও আর একটা কথা, সবাই তো রাতে রুটি খেতে চেয়েছিলেন। তাহলে ভাত অর্ডার করেছিলেন কেনো?
– কেনো করেছিলাম, মনে নাই।
– ঠিকই মনে আছে, বলবেন না, তাই!  আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
কিছুটা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কেনো?
– এই যে আপনি এখনো মনে রেখেছেন যে, আমি রুটি খেতে পারি না। সবারই ভাত খেতে একটু কষ্ট হয়েছে। এই জন্য সরি। আচ্ছা, আমি এখন আসি। সবাই মনে হয় ঘুমিয়ে গেছে। আবার জেগে থাকলে কি মনে করবে?

এই বলে চলে গেলেন। আমিও ঘুমানোর জন্য সম্পুর্ণ প্রস্তুতি নিলাম। ক্লান্ত দেহ। এক্ষুনি ঘুমানো দরকার। ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম ৯% চার্জ আছে। ফোন সাইলেন্ট করতে গিয়ে দেখি তিনি মেসেঞ্জারে লিখেছেন- আমার ঘুম আসছে না। তারপরও খুব শীত করছে। হট রেড সিনেম্যন আইস্ক্রিম খাওয়া দরকার। সামনে মধুমালা স্টেশনে নেমে কিন্তু আইস্ক্রিম খাবো। প্লিজ, না করবেন না। আমি এই দরজা দিয়ে নামবো আর আপনি ওই দরজা দিয়ে নামবেন।  আমার এখানে সবাই ঘুমাচ্ছেন। কেউ দেখবে না। চ্যাট করতে করতে পদ্মাবতী এক্সপ্রেস মধুমালা স্টেশনে থামলো। দুজনই কথা মতো নামলাম। তার কাধে পার্স আর খাবারের ব্যাগ। একজন ফেরিওয়ালাকে উনি ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে সিনেম্যন আইস্ক্রিমের দোকানের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। লোকটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন – প্লিজ, বাংলায় বলুন। আমার বাসা কলকাতায়। আমি বাংলা বুঝি।
এবার কিছুটা লজ্জা পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন- এখানে সিনেম্যন আইস্ক্রিম কোথায় পাওয়া যাবে?
উত্তরে ফেরিওয়ালা বললেন – দিদি, খানিকটা দূর আছে। সামনে গিয়ে হাতের ডান পাশের দক্ষিণ দিকের পার্বতী স্টেশনারিতে পাওয়া যাবে।
আমরা হাটা শুরু করলাম। অনেক রাত স্টেশনে খুব একটা মানুষ জন নেই। দু চার জন বসে বসে ঘুমাচ্ছে। মাঝে মাঝে কয়েকটা কুকুর শীতে গোল হয়ে শুয়ে আছে। হাটতে হাটতে অবশেষে আমরা পার্বতী স্টেশনারির দোকান টা পেলাম।

দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলেন – দাদা, দুটো সিনেম্যন আইস্ক্রিম দিন তো।
– সরি, দিদি, কিছুক্ষণ আগে ফুরিয়ে হয়ে গেছে। আপনারা ওই বেঞ্চে বসুন। আমি স্টোর রুম থেকে নিয়ে আসছি।
আমাদের বসতে ইচ্ছে করলো না। পাশেই নিরিবিলি জায়গায় দাঁড়ালাম। চোখে প্রচুর ঘুম ছিলো। এখন তেমন ঘুম নেই। দেখে মনে হচ্ছে আমাদের অনেক দিনের পরিচয়। দুজন একদম কাছাকাছি আর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন- কি থেকে কী হয়ে গেল, তাই না? 
কিছুটা অবাক হয়ে বললাম- বুঝলাম না, এটার মানে কি?
– অকে, ঠিক আছে, বাদ দেন। আচ্ছা, আপনি যে সবার মাঝখানে বসে আমার সাথে চ্যাট করেন। সবাই দেখে না?
– কিভাবে বলি? দেখে কি, দেখে না?
– এই রকম হেয়ালিভাবে উত্তর না দিলে কি হয়? সবার মাঝে বসে চ্যাট করেন, গল্প করেন, আড্ডা দেন, খাবার অর্ডার করেন আবার সবার খোঁজ নেন। এত্ত সব একসাথে কেমনে করেন? ঝামেলা বা বিরক্ত মনে হয় না?
– আরে না, এইসব আমি খুব এনজয় করি।
– আমি কিন্তু আবার একসাথে এত কিছু পারি না। ও আচ্ছা, আজ রাতে খাবার খান নি কেনো?
– এখন জিজ্ঞাসা করে কি হবে?
– কি করবো বলুন? সবার সামনে জিজ্ঞেস করলে উনারা মাইন্ড করে আবার জিজ্ঞেস না করলে আপনি মাইন্ড করেন। তাহলে আমি কি করবো? এই জন্যই তো ব্যাগে করে খাবার নিয়ে আসছি। আইস্ক্রিম আনতে আনতে আপনি খেয়ে নেন। তবে তখন কাজ টা কিন্তু ঠিক করেন নি। একটু বেশি বেশিই করছেন।
– কেন, কেউ কিছু বলেছে নাকি?
– না, তেমন কিছু বলে নি। তবে মনে হয় বুঝতে পারছে। আমি বলছি, চুল বাধার সময় মুখে ক্লিপ রাখছিলাম আর ওই টাইমে ট্রেন ব্রেক করাতে লোহার শিকলের সাথে লেগে কেটে গেছে।

এমন সময় ট্রেনের হুইসেল। ঘোষণা শুনতে পেলাম- পদ্মাবতী এক্সপ্রেস অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মধুমালা স্টেশন ছাড়বে। কোনকিছু না ভেবে হাটা শুরু করলাম। আমার ফোন, তার পার্স এবং ছোট ব্যাগ একটা বড় ব্যাগের মধ্যে নিলাম। বড় ব্যাগটা আমার কাধে নিয়ে দৌড়ানো শুরু করলাম।  উনি হাপাতে হাপাতে বলছেন – প্লিজ, আমি আর পারছি না। এটা মিস করলে না হয় পরের ট্রেনে যাবো। তবুও আর দৌড়াতে পারছি না। আমি বললাম – না, এটা সম্ভব না। এই ট্রেনেই উঠতে হবে। আমার হাত ধরে থাকুন। আর বেশি সময় লাগবে না। আমরা স্টেশনের প্রায় শেষ প্রান্তে চলে আসছি। সামনেই ৪৯ নম্বর কেবিন। আমাদের এ অবস্থা দেখে একজন গেইটম্যান গেইটে দাঁড়িয়ে আছেন। কোন মতো ডান হাত দিয়ে গেইটের হাতল ধরলেন। সাথে সাথে উপর থেকে গেইটম্যান তার বাম হাত ধরে ট্রেনে তুলে নিলেন। আমি কাধে থেকে ব্যাগ ছুড়ে দিতেই স্টেশনের প্লাটফর্ম শেষ হয়ে গেলো এবং পদ্মাবতী এক্সপ্রেস তার আপনি গতিতে চলতে শুরু করলো।

দুজনেই দুজনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। আর পদ্মাবতী এক্সপ্রেস তার ৪৯ নম্বর কেবিন নিয়ে শীতের রাত্রির নিস্তব্ধতায় হারিয়ে গেলো।

লেখক- প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *