মালেক ইকবাল।।
তুমুল লড়াই আর অনেক তিক্ততার পর ব্যাটলগ্রাউন্ড রাজ্য পেনসিলভেইনিয়ায় জয়ের মধ্য দিয়ে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। তার রানিং মেট কমলা হ্যারিস প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ও প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন। আর এর মধ্য দিয়ে বহু আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দেওয়া রিপাবলিকান দলের নেতা ডনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরের শাসনের অবসান ঘটতে যাচ্ছে। প্রায় তিন দশকের মধ্যে তিনিই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে ব্যর্থ হলেন। তার আগে ১৯৯২ সালে জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ এই পরীক্ষায় হেরে গিয়েছিলেন। নির্বাচিত হওয়ার পর জো বাইডেন বলেছেন, এখন আমেরিকাকে ‘ঐক্যবদ্ধ’ করার সময়, ‘সারিয়ে তোলার’ সময়। তিনি যদি সারিয়ে তুলতে পারেন, তাহলে আমেরিকা হবে আরও সুপার পাওয়ারের অধিকারী। তবে কিছু ভুল সিদ্ধান্ত হিতে বিপরীত হতে পারে। জো বাইডেনের মতো মানুষ এমন ভুল করবেন কিনা সেটা দেখার বিষয়?

অন্যদিকে বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, বিংশ শতাব্দী যদি যুক্তরাষ্ট্রের হয়, একবিংশ শতাব্দী হবে চীনের। বিশ বছর আগেও যে চীনকে মনে হয়নি তারা কখনো সুপার পাওয়ার হতে পারে, সেই চীনই এখন যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিচ্ছে। বাণিজ্যযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে জবাব দিচ্ছে চীন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্ককে অনেকে দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ বলে থাকেন। কার হাতে থাকবে সুপার পাওয়ার? এমন ধরণের প্রশ্ন ঘুরে ফিরে প্রায়শঃই ফেসবুকে দেখি; সংগে দেখি বিভিন্ন মতামত, গবেষনা, গল্প-কথা। মহাত্ম গান্ধি থেকে শুরু করে অনেকেই নাকি ক্রমান্বয়ে চায়না এবং এরপর ইন্ডিয়াকে সিরিয়াল দিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ আমেরিকা এক সময় তার ক্ষমতা হারাবে এবং সেই সুপার পাওয়ার এর স্থানটা দখল করবে চায়না। চীন যার হাত ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুপার পাওয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তিনি চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং।

ফোর্বসের তথ্যমতে, শি জিন পিং বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ছয় বছরের মধ্যেই তিনি এই অবস্থানে চলে এসেছেন। অর্থাৎ, তিনি পেছনে ফেলেছেন ভ্লাদিমির পুতিন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। শি জিনপিং মাও সে তুং এর পর দ্বিতীয় নেতা, যার আদর্শ ও চিন্তাধারা জীবিত অবস্থায়ই চীনের সংবিধানে লেখা হয়েছে। ২০১৮ সালে চীনের সংসদে প্রেসিডেন্টদের দশ বছর মেয়াদী ক্ষমতায় থাকার আইন তুলে দেয়া হয়। অর্থাৎ, শি জিনপিং এখন আজীবন চীনের প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন। অর্থাৎ শি জিনপিং হবেন সুপার পাওয়ার এর অধিকারী।

কিন্তু বাস্তবতা কি বলে সেটা একটু চিন্তা করে দেখা দরকার। চায়নার বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৪৩ কোটি এবং তাদের বার্ষিক মাথাপিছু (নমিনাল) আয় ১০,৮৭২ ডলার, এবং টোটাল অর্থনীতির সাইজ প্রায় ১৫ ট্রিলিয়ন ডলার। অপরদিকে আমেরিকার বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৩৩ কোটি এবং তাদের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৬৭,৪২৬ ডলার, এবং টোটাল অর্থনীতির সাইজ প্রায় ২২ ট্রিলিয়ন ডলার। প্রকৃতপক্ষে বার্ষিক মাথাপিছু আয়ের হিসাবে একটা দেশের অর্থনীতি বা দেশটির আর্থিক সক্ষমতা কিছুটা উপলব্ধি করা যায়; সেই হিসাবে একজন আমেরিকানের বার্ষিক ৬৭ হাজার ডলারের বিপরীতে একজন চাইনিজের বার্ষিক আয় ১০ হাজার ডলার বা প্রায় ৭ ভাগের এক ভাগ। চায়না যতদিনে ৬৭ হাজার ডলার বার্ষিক আয়ে পৌছবে ততদিনে আমেরিকান বার্ষিক আয় কয়শ হাজার ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে! আবার আমেরিকার ৩৩ কোটি জনসংখ্যা পরিবর্তে চায়নার ১৪৩ কোটি জনসংখ্যা যদি বোঝা হয়ে দাড়ায় তাহলে হিসাবটা উল্টে যেতে পারে। চায়না আরও ১ হাজার বছর ধরে তাদের বর্তমান ধারা বজায় রাখলেও আমেরিকার ধারে-কাছেও ভিড়তে পারবে না; সুপারপাওয়ার হওয়া তো অনেক দূরের হিসেব।

প্রকৃতপক্ষে আমেরিকার কোন গণপ্রডাক্ট নেই যেটা বিক্রি করে আমেরিকাকে চলতে হয়; যেমন রয়েছে চায়নার; তাদের ১৪৩ কোটি মানুষ প্রডাক্ট তৈরীতে ব্যস্ত; সেই প্রডাক্টস তৈরী করে তারা টাকা ইনকাম করে। কিন্তু আমেরিকা সেভাবে কোন প্রডাক্ট তৈরীও করে না। উপরোন্ত আমেরিকার নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য দ্রব্যাদির প্রায় ৭০%ই ইমপোর্ট করা হয় চায়না থেকে। তাহলে, আমেরিকা করেটা কি? এখানেই কিন্ত আমেরিকার সুপার পাওয়ার এর রহস্য।

আমরা আজ সোসাল মিডিয়া ব্যবহার করছি, ইকমার্স করছি তার সবই আমেরিকায় তৈরী হওয়া। ইন্টারনেটসহ আধুনিক যা কিছু প্রযুক্তি তার সবই আমেরিকানদের মাথা থেকে বের হয়।আবার আমেরিকায় যে পরিমান খনিজ তেল আর গ্যাস রয়েছে তার যদি তারা তুলে বিক্রি করে- তাহলে তেলের দাম পানির দামের সমান হয়ে যাবে বাদ বাকী বিশ্বে। আমেরিকার যে পরিমান খালি জায়গা রয়েছে সেখানে যদি ধান চাষ করা হয়, সেই ধান বিক্রি করেই ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার রাজস্ব আসতে পারে। বোয়িং এর বিমান বা স্যাটেলাইন এর প্রসংগও কিন্তু বড় একটা ফ্যক্ট।
আসলে আমেরিকা চলে শুধুমাত্র তাদের মাথার বুদ্ধি বিক্রি করে। আর মাথায় যদি বুদ্ধি থাকে তাহলে চলতে টাকা লাগে না। টাকা এমনিতেই চলে আসে। আমেরিকার টাকা এমনিতেই আসে। আমেরিকার শক্তি, ক্ষমতা, টাকা এসব সম্পর্কে আমরা ধারণাও করতে পারি না। এক আমেরিকার ডলারের ভয়ে, পুরো পৃথিবী অন্যায্য জেনেও ইরানের সংগে ব্যবসা করার স্পর্ধা দেখায় না, আমেরিকা রাগ হলে তারা দেওলিয়া হয়ে যাবে এই ভয়ে।

আমেরিকা তার দু’টি মহাদেশের একক ক্ষমতাধর দেশ। উত্তর বা দক্ষিন আমিরেকার বলতে গেলে সবগুলি দেশই আমেরিকার কথায় উঠ-বস করে। আমেরিকাস দেশগুলো অনেকেই আজ আমেরিকান ডলার ব্যবহার করছে নিজেদের মুদ্রা বিলুপ্ত করে। শুধুমাত্র উত্তর-দক্ষিন আমেরিকা নয়, প্যাসিফিক রিজিয়নেও বেশীরভাগ দ্বীপরাষ্টও আজ আমেরিকান ডলার ব্যবহার করে থাকে। আর চায়না তাদের নিজেদের দক্ষিন চীন অঞ্চলটুকুই ঠিক মতো রক্ষা করতে পারছে না- এতটাই অসহায় তারা।

ভারতের কথা বলি। ভারত বড় জোর বাংলাদেশ পাকিস্তানের সংগে প্রতিযোগিতা চালিয়ে যেতে পারবে সমানে সমানে কিন্তু কোন কালেও এশিয়ান পাওয়ারও হতে পারবে না-সুপারপাওয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখা তো দূরের কথা। আসলে আমেরিকা নিজেদের অবস্থান এমন এক উচ্চতায় তৈরী করে ফেলেছে যে ওখানে কেউ হাত লাগাবার কথা চিন্তাও করতে পারবে না।

অন্যদিকে চীনাবাসী এবং আমেরিকার শত্রুপক্ষ তাকিয়ে থাকবে শি জিন পিং এর দিকে। শি জিনপিং দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের মাধ্যমে জনগণের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও এতে তার অনেক শত্রু সৃষ্টি হয়েছে। ফলে তিনি ক্ষমতাহীন হয়ে পড়লে বাকি জীবন হয়তো জেলেই কাটাতে হবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীনের আধিপত্য বিস্তার করতে হলে তার দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষমতায় থাকার প্রয়োজন। এসব কারণেই হয়তো প্রেসিডেন্টের মেয়াদের সময়সীমা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

তিনি উত্তর কোরিয়ার মতো অনলাইন মাধ্যম খুব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন। তার নামে কোনো সমালোচনামূলক কথা লেখা বা বলা অনলাইন-অফলাইন উভয় ক্ষেত্রেই নিষিদ্ধ। আন্তর্জাতিক পত্রিকাগুলোর অনলাইন ভার্সন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটারসহ গুগল, ইউটিউব চীনে নিষিদ্ধ করে রেখেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন বাণিজ্যিক যুদ্ধে, উইঘুরের মুসলমানদের উপর নির্যাতন চালানোর নির্দেশ দেয়ার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।

তবে এসব কোনো অভিযোগই গায়ে মাখছেন না তিনি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৪৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা গ্রহণের শতবার্ষিকীতে চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের তিন গুণ ছাড়িয়ে যাবে। সেটা পারবে কি না সময়ই বলে দেবে। আর যদি সত্যিই চীন সুপার পাওয়ার হয়ে যায়, সেটা হবে শি জিনপিং এর কারণেই। তবে সেটা অনেক শর্তযুক্ত।

একটি ব্যাপক ও ধ্বংশাত্বক বৈশ্বিক যুদ্ধ যদি কোন কালে পুরো পৃথিবীকে উলট-পালট করে দিতে পারে শুধুমাত্র তখনই আমেরিকার জায়গাটা অন্য কেউ নিতে পারবে- যদিও সামরিক শক্তি, প্রযুক্তি এবং উন্নয়নের এই যাত্রাপথে তেমনটা হবার মতো কোন পরিবেশ তৈরী হওয়া বর্তমান বাস্তবতায় অসম্ভব।

লেখক- প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *