মালেক ইকবাল।।
“ফেয়ার এন্ড লাভলী” রঙ ফর্সাকারী ক্রিম। এই
বিজ্ঞাপনটা দেখেন নি বা দেখে এই রকম প্রসাধনী ব্যবহার করেন নি এমন মানুষের সংখ্যা  খুবই কম। আচ্ছা কখনো কি এই ধরনের বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন? এটা কি বর্ণবাদকে প্রমোট করে না? বিউটি পার্লার থেকে বের হয়ে বর্ণবাদের বিপক্ষে মিছিল করবেন সেটা তো হয় না। সাদা শান্তির প্রতীক আর কালো অশান্তি বা শোকের প্রতীক,  এটা কোথায় থেকে আর কেনই বা শুরু করলেন? কোন যুক্তি কি আছে এর পক্ষে? এর ইতিহাস কি? বিয়েতে সাদা আর লাল মিশ্রিত শাড়ি পরবেন আর শোক দিবসে কালো শাড়ি পড়বেন। এসব করে আবার বর্ণবাদের বিপক্ষে কথা বলবেন, বিষয় টা স্ববিরোধী হয়ে গেল না। পায়রার মধ্যে আবার বর্ণবাদ, কে নিয়ে আসলো? সাদা রঙের পায়রা উড়িয়ে উৎসব শুরু করেন কেনো? কালো রঙের পায়রা কি অপরাধ করছে?

আমরা ফেসবুকবাসীরা  আমেরিকার জর্জ ফ্লয়েড এর হত্যাকাণ্ডের জন্য বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মিছিল করছি। বিভিন্নভাবে ট্রল করছি।বলছি কেন কালো চামড়ার মানুষ ফ্লয়েডকে হত্যা করা হলো।  এখানে কালো শব্দের ব্যবহারটা কি বর্ণবাদকে উস্কে দেয় না? শুধু ফ্লয়েড হত্যার বিচার চাইলেই ত হয়। আবার কালো চামড়ার ফ্লয়েড বলতে হবে কেন? আমরা কি জাতীয় দলের পেসার রুবেল হোসেনকে কালু বলিনি? এমন ঘটনাও ঘটতে শুনেছি, রুবেল হোসেন বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করছে আর দর্শকরা গ্যালারি থেকে কাউয়া কাউয়া বলে চিৎকার করছে। এগুলোও কি বর্ণবাদি আচরণ না?

২০১৫ সালের আগস্টে এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুমাইয়া শিমু নাসিরউদ্দিন নাসিম নামে দেখতে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি কালো এক ব্যবসায়ীকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তাদের কাপল ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করার সাথে সাথে চারদিকে ছি…ছি… রব উঠতে শুরু করে। কারণ, সুমাইয়া শিমুর মত একজন সুন্দরী অভিনেত্রীর সাথে এই কালো মানুষটা কোনোভাবেই মানান সই হতে পারে না। আর এটা নিয়ে আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রীতিমত ট্রল করেছি আর বলেছি, ভাই, আপনি জিতছেন। ফেসবুকে ফর্সা আর কালো কাপল দেখলেই বলি, কিসের মেসি, কিসের নেইমার? কাপ জিতেছেন আপনি। ক্রিস গেইলকে দেখে কি বলিনা, শালা ক্যালি হেব্বি ছক্কা মারতে পারে। বিয়ের বিষয়ে মেয়ে বা ছেলেকে কিন্তু অবশ্যই ফর্সা হতে হবে। এর কিছুক্ষণ পরেই কিন্তু বর্ণবাদ নিয়ে বড় বড় বুলি কব্জাই। নিজের ভুলটা ধরা কবে শিখবো? আমরা মানুষ কখনোই নিজের দোষটা দেখতে পাই না। তাই আমরা সর্বদা অন্যের দোষ নিয়ে সমালোচনা করতে পছন্দ করি এবং বিজ্ঞ বিজ্ঞ কথা বলি। নিজের সন্তানের কান্নার মধ্যে জাস্টিন বিবারের কন্ঠ ভেসে আসে আর অন্যের সন্তানের কান্না বিরক্ত লাগে। আমি বা আমরাও যে বর্ণবাদি কর্মকান্ডে দুষ্ট তা কখনো উপলব্ধিই করতে পারি না।

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ব্যবহৃত মিডিয়া হাউজগুলো কি বর্ণবাদ থেকে মুক্ত? অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় মিডিয়ায় বেশি বর্ণবাদের শিকার হতে হয়। এক জরিপে দেখা গেছে, মিডিয়া হাউজেই বর্ণবাদের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে। মিডিয়ায় নারীরা পদে পদে বর্ণবাদের স্বীকার হচ্ছে। আপনি টেলিভিশনের উপস্থাপিকার মধ্যে একজনকেও পাবেন না, যার গায়ের রং কালো অথবা শ্যামলা। শ্যামলা হলে তাকে মেকাপ রুমে নিয়ে ডিসটেম্পার মেরে সাদা বানানো হচ্ছে। অর্থাৎ বর্ণবাদের আবরণে বর্ণবাদকেই প্রমোট করা হচ্ছে। এমন নজির আছে শুধু গায়ের রঙ কালো হওয়ার কারণে বিউটি প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। এটাও কি বর্ণবাদি আচরণ না?
একজন এমন একটা কাজ করলো যেটা তার সাথে মানায় না। তখন আমরা হরহামেশাই বলে ফেলি,  হাসান মাসুদ যদি ফেয়ার এন্ড লাভলী’ এর এড দেয় সেটা কি মানায়?  অথচ জেমস-আইয়ুব বাচ্চু যখন মাদক বিরোধী কনসার্ট করে তখন আমরা সেটা নেচে নেচে মাতিয়ে ফেলি। এটা কি বর্ণবাদের মতই আমাদের স্ববিরোধী অবস্থান নয়?

বিউটি পার্লার থেকে বের হয়ে কালো চাকার সাদা গাড়িতে চড়ে বর্ণবাদের আন্দোলন করলে সেটা কখনও ফলপ্রসূ হবে না। দুর্ভাগ্য বোঝাতে কালো, আর শান্তি বোঝাতে সাদার ব্যবহার যত দিন থাকবে, তত দিন থাকবে বর্ণবাদ। বিয়ের পোশাক সাদা, আর শবযাত্রায় কালো পোশাকের চল যত দিন থাকবে, তত দিন থাকবে বর্ণবাদ। স্নুকার খেলায় যেদিন সাদা গুটি নিচে আর কালো গুটি উপরে রাখার চল আসবে সেই দিন আর বর্ণবাদ থাকবে না। কে জানে সেই দিন কতদূর!  তবুও আশায় রইলাম৷ হয়তো খুবই নিকটে।

লেখকঃ প্রভাষক,  ইংরেজি বিভাগ তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *