মালেক ইকবাল।।
সবকিছু বদলে গেছে, শুধু বদলাইনি আমি। কেবল তার জন্যই এখানে আসা। এক সময় আপন বলতে তিনিই ছিলেন। তার সাথে আত্মার সম্পর্ক। অনেক বছর বাহিরে থাকলেও তার হাতের মাষ কালাইয়ের রুটি এখনও মিস করি। ফেবারিট খাবার বলতে এটাই বুঝি। সাথে যদি ধনিয়া চাটনি, লবণ ঝাল আর হাঁসের মাংস থাকে তাহলে তো কথাই নাই। এতদিন পর দেখা হবে। ভাবতেই কেমন যেন লাগছে! মনে হাজারো ভাবনা। বাসার গেইটে পা রাখতেই শরীর টা ভারী হয়ে গেল। পাশে কয়েকজন ছেলেমেয়ে খেলা করছে। আমাকে দেখে তারা সবাই একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। হয়তো ভাবছে এই ভিন দেশী আবার কোথায় থেকে আসলো? এরই মধ্যে তিনি বের হয়ে আসলেন। নিজের ঠোঁটের উপর আঙুল দিয়ে বাচ্চাদের চুপ থাকতে বললাম। পিছনে গিয়ে হাত দিয়ে তার চোখ চেপে ধরলাম। সমস্ত শরীর শীতল হয়ে গেল। কী যে অনুভূতি! মনে হচ্ছে সারা পৃথিবীর গুপ্তধন আমার হাতের নিচে। দু হাতের চার পাঁচটা আঙুল অশ্রুতে ভিজে গেল। তার বুঝতে আর বাঁকি রইল না যে আমি আসছি। এবার চোখ থেকে হাত দুটো খুলে আমার দু গাল চেপে ধরলেন। খুশিতে কিছুই বলতে পারছেন না। শুধু আমার মুখের দিকে চেয়ে আছেন। মুখে কিছু বলতে না পারলেও তার চোখ আর ঠোঁটে না বলা অজস্র কথা খেলা করছে। গাল থেকে হাত নামিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। দুজনেই চুপচাপ। কোন শব্দ নেই। হঠাৎ কান্নার আওয়াজ। ছোট বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। অজানা কারণে তাদের চোখেও পানি। পরিবেশটা একদম ভারী হয়ে গেছে। কপালে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বললেন – আমি জানতাম, তুই একদিন ঠিকই ফিরে আসবি।

নিজের আবেগকে কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারলাম না। বাচ্চাদের মতো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না শুরু করে দিলাম। হাত দিয়ে তার দু পায়ে সালাম রাখতেই বুকে টেনে নিয়ে বললেন- আরে পাগল কি করিস! তুই আমার বুকে আয়। কতদিন ধরে তোরে আদর করি নাই। এবার আমার চোখের পানি মুছে দিলেন। হাত ধরে বারান্দার সিড়িতে বসালেন। ছোটবেলা থেকেই তাকে দাইমা বলে ডাকি। এলাকার সবাই এ নামেই ডাকে। কারণ উনার অনেক ক্ষমতা। তার হাত ধরে অনেক শিশু এই পৃথিবীতে এসেছে। এক সিড়ি নিচে তার পায়ের কাছে বসলাম। ইচ্ছে করছে তার পায়ের উপর মাথা রেখে ঘুমাই। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর জিজ্ঞেস করছেন – তোর চাকরি কেমন চলছে?
– ভালো চলছে। আচ্ছা দাইমা, তুমি এখানে কার সাথে থাকো?
– আমার সাথে পল্লবী থাকে আর তার ছোট ভাই।
কিছুটা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- পল্লবী কে?
– আরে কি বলিস, তুই পল্লবীকে চিনিস না? অই যে তুই যার সাথে ছোটবেলায় খেলা করতি। আর মাষ কালাই ভাঙানোর সময় মারামারি করতি। তুই তো তাকে পল্লী বলে খেপাতি।
-ও, আচ্ছা। এইবার মনে পড়ছে। দাইমা, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। এইবার কিন্তু তোমার হাতের কালাইয়ের রুটি না খেয়ে যাব না।
– ঠিক আছে, তুই না বললেও আমি তোকে না খেয়ে যেতে দিব না। আচ্ছা, তুই কি এখনও পানির সাথে আইস কিউব খাস?
– হুম, এখনও খাই। শীতের মধ্যেও আইস ছাড়া পানি খেতে পারি না।
কথা বলতে বলতে আমি দরজা হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় একজন দরজা ধাক্কা দিয়ে ভিতরে আসলেন। দাইমাকে জিজ্ঞেস করলাম- দাইমা, উনি কে?
– ওই তো, পল্লবী। পাশের স্কুলে চাকরি করে। গণিতে খুবই ভাল। সবাই ম্যাথ মিস বলে ডাকে। বাবা- মা মারা যাওয়ার পর থেকে আমার কাছেই থাকে। আমার খুব যত্ন নেয়। ওর একটা ভাল বিয়ে দিতে পারলেই আমি বাঁচি। ও, শোন, কালকে ছেলে পক্ষ পল্লবীকে দেখতে আসবে। তুই থাকিস। কোথাও যাবি না।

এসব শুনে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। দাইমার অনেক কষ্টের জীবন। সারাজীবন শুধু দিয়েই গেলেন। কিছুই আর পেলেন না। দাইমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম- দাইমা, তুমি আমাকে মাফ করে দাও।
– কী বলিস, এসব আবোল তাবোল? 
– না, যখন তোমার প্রয়োজন ছিল, তখন তোমার জন্য কিছুই করতে পারি নাই। তুমি এখন আমার সাথে চলো।
বিস্মিত হয়ে দাইমা জিজ্ঞেস করলেন- কোথায়?
– কেন, ডেনমার্কে! সেখানে তুমি অনেক ভাল থাকবে। সেখানকার জীবন অনেক সুন্দর। তোমার কিচ্ছু করতে হবে না। শুধু আমাকে কালাইয়ের রুটি বানিয়ে খাওয়াবে। 
পাটের রশি দিয়ে বানানো খাটের উপর বসে পল্লবী মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনছে। এবার দাইমা তাকে ড্রাম থেকে মাষ কালাই বের করতে বললেন। আর ফ্রিজে পানি রাখতে বললেন আইস কিউব বানানোর জন্য। ফিরে এসে পল্লবী জিজ্ঞেস করলেন- দেখে তো মনে হচ্ছে আপনার ঠান্ডা লাগছে। তবুও পানির সাথে আইস খাবেন? আচ্ছা পানির সাথে আইস খান কেন?
– খাই, ছোটবেলার অভ্যাস। কেন বলুন তো?
– না, মানে। আমি শুনেছিলাম মানুষ আইস অন্য কিছুর সাথে খায়। তাই আর কি!
– মানে কি?
– মানে কিছু না, আচ্ছা, আপনি কোথায় পড়াশোনা করেছেন?
– ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ডেনমার্ক।
এরই মাঝে দাইমা তাকে আমার জন্য বেড ঠিক করতে বললেন। দুইটা রুম পাশাপাশি।  বিপরীত পাশে আরেকটা ছিমছাম গোছানো রুম। সেই রুমে পল্লবী থাকে। মাঝখানে মাঝারি সাইজের একটা উঠান। সেখানে একটা পাটের রশির দোলানো খাট। দাইমাকে বললাম- বাহিরে খুব সুন্দর বাতাস। আমি আজ খাটের উপরই থাকবো। এক গ্লাস পানি চাইতেই পল্লবী পানি নিয়ে হাজির।
– কী ব্যাপার, আইস কোথায়?
– প্লিজ, আপনার ঠান্ডা লাগছে। আজকে না হয় আইস ছাড়াই খেলেন। একদিন তো। এই বলে তিনি তার রুমে চলে গেলেন।

আকাশে হাজারো তারার মেলা। মাঝখানে চাঁদ মিটিমিটি আলোতে জ্বলজ্বল করছে। খাটের আশাপাশে ঝি ঝি পোকার আওয়াজ। দূর থেকে কানে ভেসে আসছে শেয়ালের হাঁক। ঝিরিঝিরি বাতাসে খাটের উপর ল্যাপটপ নিয়ে প্রজেক্টের কাজ করছি। আগামী সপ্তাহে কাজটা হ্যান্ড অভার করতে হবে। বহুদিন পর এরকম পরিবেশে বসে আছি। ওদিকে পল্লবীও তার রুমে পড়ার টেবিলে বসে আছে। রুমের লাইট অফ করে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পরিক্ষার খাতা দেখছে। নিচের জালানা খোলা। অন্ধকার ঘরে টেবিল ল্যাম্পের আলোতে তার মুখটা একদম সিলিকনের মত ঝিলিক দিচ্ছে। মাঝখানে সিথি করা চুল দু ঘাড়ের উপর আছড়ে পরছে। গলায় স্বর্ণের চেইনটা চিকচিক করছে। লোকেটে দু এক অক্ষরে কি যেন লেখা, বুঝতে পারলাম না। জানালা দিয়ে কিছু আলো বের হয়ে উঠানে আসছে। মনে হচ্ছে তার ফেস থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। পরে খেয়াল করে দেখি
বাহিরের চাঁদের আলো সসম্পূর্ণরুপে তার মুখের উপর খেলা করছে। দুই ভ্রুর মাঝখানে কালো রঙের ছোট্ট একটা টিপ। নাকের বাম পাশে মাঝারি সাইজের নথ। দূর থেকে তাকে এনিম্যাটেড মনে হচ্ছে যেন কোন চিত্রকর নিজ হাতে স্বপ্নের মতো করে রঙ তুলির স্পর্শ দিয়েছে। আমার চোখে চোখ পড়তেই হঠাৎ টেবিল ল্যাম্প টা অফ করে দিলেন। মুহুর্তেই রুমটা অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।  চাঁদ মামাও তার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এদিকে আমার প্রজেক্টের ড্রয়িং এর পরিমাপ কিছুতেই মেলাতে পারছি না। সেন্টিমিটারে আটকে আছে।

কিছুটা ঘুম ঘুম ভাব। হঠাৎ পায়ের শব্দ। মনে হলো আমার পাশে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে? চোখ খুলে দেখলাম পল্লবী। কিছুটা আক্ষেপ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- এক্সকিউজ মি, আপনার সাথে জরুরী  কিছু কথা আছে।
খাটে থেকে উঠে বললাম- জ্বি বলুন।
– আমি চাই না আপনি এখানে আসুন এবং দাইমার কাছে থাকুন। আর দাইমাকে কেন নিয়ে যাবেন? সেটা আমি জানি।
– কেন নিয়ে যাব?
– নিজের ঘরের কাজ করানোর জন্য নিয়ে যাবেন।
আমি অবাক হয়ে বললাম – কি সব বাজে বকছেন! এখানে এসেছি শুধু দাইমাকে নেওয়ার জন্য।
– তার প্রয়োজনের সময় কোথায় ছিলেন? এখন আসছেন তাকে নিতে।
তার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। মনটা ভীষণ খারাপ। কন্ঠ ভারী হয়ে গেছে। কথা বলতে পারছে না। হাত দিয়ে বারবার চোখের পানি মুঝছেন আর বলছেন- প্লিজ, আপনি দাইমাকে নিয়ে যাবেন না। আমি জানি সে আপনার মায়ের মতো।  কিন্তু সে তো আমারও মা, তাই না? আপন বলতে সে ছাড়া আমার কে আছে বলুন? আপনার তো এখন সবই আছে। আর আমার আছে শুধু দাইমা। তাকে নিয়েই বাঁচতে দিন। প্লিজ, দোয়া করে আপনি দাইমাকে নিয়ে যাবেন না।
– দাইমা আমার সাথে যাবেন। এটা আপনার ভাল লাগুক বা খারাপ লাগুক। দাইমাকে আমি নিয়ে যাবোই। কান্না করতে করতে তিনি রুমে চলে গেলেন। পাশেই দেখি দাইমা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে কান্না করছেন। কিছু না বলে চোখের পানি মুছতে মুছতে তার রুমের দিকে রওনা দিলেন। কিছুই ভালো লাগছে না। গলা শুকিয়ে আসছে। পানি খাওয়া দরকার। খাট থেকে উঠে ফ্রিজে পানি আনতে গেলাম। গ্লাসে আইস কিউব নিচ্ছি। হঠাৎ পিছন থেকে হাতটা আলতো করে ধরে বললেন- প্লিজ, পানির সাথে আইস খাবেন না। এমনিতেই আপনার ঠান্ডা লাগছে।

রাত প্রায় ১২ঃ২৯ মিনিট। চারিদিক একদম নিরব। নিস্তব্ধ রাতটাকে বেশ গভীর মনে হচ্ছে। প্রজেক্টের কাজের প্রতিও মনযোগ দিতে পারছি না। সেই সেন্টিমিটারে এখনও আটকে আছি। কম্পিউটারে ১৩, ১৩.৫০, ১৪ সেন্টিমিটার দেখাচ্ছে। দুটি পয়েন্টের দূরত্ব কত সেন্টিমিটার রাখলে মিলবে সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। খুবই চিন্তায় পড়ে গেলাম। একটু হাটাহাটি শুরু করলাম। তার রুমের কাছে যেতেই দেখি আবার আলো।

রুমের পাশে বড় একটা বেলকুনি। সেখানে একটা বেঞ্চ আর একটা টেবিল। টেবিলের ওপর কয়েকটা বই। বেঞ্চের উপর মন খারাপ করে বসে আছে। ডান পায়ের উপর বাম পা। ডান হাতটা কোলের মধ্যে। কালো রঙের ঘড়ি পরা বাম হাতটা থুতনির নিচে দিয়ে কি যেন ভাবছেন? চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই। ডান দিকের বেশ কিছু চুল ভ্রু স্পর্শ করে আছে। গায়ে খুবই সাধারণ একটা রঙিন সালোয়ার কামিজ। মাথায় হাল্কা মিষ্টি কালারের ওড়নার হাফ ঘোমটা। ওড়নাটা পেচিয়ে এক পাশ ডান হাতের নিচে আর অন্য পাশ কাধের উপর দিয়ে পিঠের উপর পড়ে আছে। চাঁদের আলো কিছুটা বাঁকা হয়ে তার দিকে কিরণ দিচ্ছে। সেই আলোতে তার সৌন্দর্য আরও বেশি প্রস্ফুটিত হচ্ছে। আমার পায়চারি দেখে বললেন – কোন সমস্যা?
– না তেমন কিছু না। শুধু সেন্টিমিটারে সমস্যা।
– মানে বুঝলাম না।
– আচ্ছা, আপনার কপালের ওই কালো টিপ থেকে ঠোঁটের বাম পাশে নিচে ছোট্ট তিলের দূরুত্ব কত সেন্টিমিটার?
এইবার মাথা তুলে আমার দিকে তাকালেন। অবাক হলেও কিছুটা লজ্জা পেলেন। মুচকি হাসি দিয়ে বললেন – আজিব, এটা কি ধরনের প্রশ্ন? আমি কি কখনও মেপে দেখেছি নাকি?
– এখন মেপে দেখতে পারেন।
– কিভাবে?
– স্কেল আছে না? সেটা দিয়ে।
– কিন্তু স্কেল দিয়ে কিভাবে মাপবো? কপাল থেকে ঠোঁটের কাছে আসলে স্কেল তো উঁচু হয়ে থাকবে।
-ও, আচ্ছা। আপনার কাছে সুতা আছে?
– এখানে নাই। দাইমার রুমে আছে।
– ওকে, লাগবে না। আপনার ওড়না থেকে একটা সুতা বের করেন। সুতা বের কর‍তে চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। অলরেডি ৩/৪ টা ছিড়ে ফেলেছেন। আমার কাছে দিতেই একসাথে দুইটা সুতা বের করলাম। মাপতে বললে তিনি পারলেন না। এইবার আমাকে বললেন। আমি সুতা নিয়ে তার কপালের টিপের উপর সুতার এক প্রান্ত চাপ দিয়ে ধরলাম। আর অপর প্রান্ত তিলের উপর রেখে মাপ নিচ্ছি। হঠাৎ অনুভব করলাম আমার নিঃশ্বাস গরম আর ভারি হয়ে যাচ্ছে। একটু ভাল করে খেয়াল করে দেখলাম তিনি ধীরে ধীরে হালকা উষ্ণ নিঃশ্বাস ছাড়ছেন। চোখ দুটো বন্ধ করে রেখেছেন। আমিও তার দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছি! নিজেকে হারিয়ে ফেললাম কিছুক্ষণের জন্য। কয়েক সেকেন্ড পর নিজেকে ফিরে পেয়ে বললাম-  প্লিজ, চোখ খুলুন।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন – কত?
আমিও হাফ ছেড়ে বললাম – ১৩ঃ৩৯ সেন্টিমিটার। এরপর কিছু না বলে প্রজেক্টের কাজে মন দিলাম। দুই পয়েন্টের দূরত্ব ১৩ঃ৩৯ সেন্টিমিটার দিতেই ফাইল সাবমিট হয়ে গেল। তার দিকে একবার চেয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।

বহুদিন পর আযান এবং মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙলো। বারান্দার সিড়িতে ব্রাশ হাতে বসে আছি। ওইদিকে পল্লবী হাত মুখ ধুচ্ছে। কেবলে ঘুম থেকে উঠছে। খুবই ফ্রেশ লাগছে। এখনো টাওয়াল ব্যবহার করেনি। পানির বিন্দু মুখে লেগে আছে। এখন অবশ্য কপালে টিপ নেই। আমার সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন – আপনার কিছু কি লাগবে?
উত্তর না দিয়েই আমি জিজ্ঞেস করলাম- আচ্ছা,  আপনি কি আমেরিকার ফাইন ভাইন টুথপেষ্ট ব্যবহার করেন?
– জ্বি, কিভাবে বুঝলেন?
– আপনার দাঁত দেখেই বুঝতে পারছি। আমার খুব পছন্দের। নিয়ে আসতে ভুলে গেছি।
এটা শুনে রুমে থেকে নিয়ে আসলেন। একদম অল্প আছে। এক হাত দিয়ে চাপ দিচ্ছি কিন্তু বের হচ্ছে না। এবার উনি দু হাত দিয়ে চাপ দিতেই আমার টি শার্টে মেখে গেলো। কয়েক বার সরি বলতেই আমি বললাম – আরে না, ঠিক আছে। সমস্যা নেই।
– আজকে কিন্তু আপনাকে দেখতে আসবে। ও, বুচ্ছি। এই জন্যই এত সুন্দর করে ফ্রেশ হচ্ছেন।
– কি বলছেন এসব! আমি ওখানে বিয়ে করবো না। তাদের শর্ত চাকরি করা যাবে না। তার মানে বাসায় কাজ করতে হবে আর অন্যের কথা শুনতে হবে। তারপরও ওই ছেলেকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
– তাহলে কেমন ছেলে হলে সম্ভব?
এইবার কিছুটা নিরব। কোন উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- আচ্ছা, আপনি কি একবারেই ডেনমার্ক চলে যাবেন? আর কখনও আসবেন না?
পাশেই দাইমা ডাল বাটতে ছিলেন। তার মুখে অজানা কারণে এক ফালি হাসি। মনে হলো বড় দায়িত্ব থেকে বাঁচলেন। আমি দাইমার দিকে তাকাতেই মুখ ফিরিয়ে ডাল বাটায় মনোযোগ দিলেন।

এবার কালাই রুটি বানানো শিখতে চাই। তাই দাইমাকে জিজ্ঞেস করলাম- আচ্ছা দাইমা, কালাই রুটিতে কি কি দিতে হয় আর কিভাবে বানাতে হয়?
– আরে তেমন কঠিন না। একদম সহজ। প্রথমে এক ভাগ চালের আটা, তিন ভাগ কালাইয়ের আটা মিশিয়ে পানি দিয়ে আটার গোল ডো বা বল তৈরি করতে হয়। বল দুই হাতের তালুর চাপে চাপে বড় করতে হয়। মাটির খোলায় বা তাওয়ায় এপিট ওপিঠ সেঁকতে হয়। তারপর চুলা থেকে নামাতে হয়। এইতো আর কি? তারপর খেতে হয়।
– ঠিক আছে। এখন দাও খাওয়া শুরু করি।
– আরে এখনো হয় নি তো। এই বলে দাইমা পানি চাইলেন। পল্লবী পানি দিতেই খাওয়া শুরু করলেন। হঠাৎ পানি আটকে কথা বলতে পারছেন না। কেমন যেন করছেন? চোখ দুটো বারবার উল্টে যাচ্ছে। একদম নিস্তেজ হয়ে গেলেন। কি করবো কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। পল্লবীর কান্না দেখে চোখের পানি আটকাতে পারলাম না। নিজেকে একটু কন্ট্রোল করে তাকে বললাম – আশেপাশে কোন ডক্টর নেই? না হলে হসপিটালে নিতে হবে। কোনকিছু না ভেবে হসপিটালে নিলাম। তিন দিন হলো। তেমন কোন ইম্প্রুভ নেই। তবে ডক্টর বলেছেন সুস্থ হতে সময় লাগবে। বাহিরে থেকে ওষুধ নিয়ে কেবিনের ওপর দাইমার পাশে বসলাম৷ পল্লবীর হাতে ওষুধ দিতেই কান্না শুরু করে দিলেন। পাশেই তার ছোট ভাই চুপচাপ বসে আছে। মুখে কোন কথা নাই। চোখে পানি ছলছল করছে। তাদের দুজনের মুখে এক রাজ্য অন্ধকার। কিছুটা সান্ত্বনা দিয়ে বললাম-
আরে তেমন কিছু হয়নি। কয়েক দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে যাবেন।
নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে কাপাকাপা কণ্ঠে বললেন- আপনি মনে হয় ভুলে ফোন রেখে গিয়েছিলেন। বারবার ফোন আসতে ছিল। তাই রিসিভ করেছিলাম।
– কি বলেছেন?
– সম্পূর্ণ প্রজেক্ট ফাইল কাজ করছে না। আজকেই আপনাকে চলে যেতে হবে আর ইমেল চেক কর‍তে বলেছেন। সেখানে টিকিট আছে।

এটা শুনে তো মাথায় হাত। কি করবো? কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। দাইমাকে দেখে কিছুই ভাল লাগছে না। এইভাবে রেখে যাওয়াটা কেমন হবে? তাকে যে বুঝিয়ে বলে যাব সেটারও উপায় নেই। চোখ মেলে তাকাতেই পারছেন না। ওদিকে পল্লবী বা একা একা কি করবে? সবাই চুপচাপ। কারও মুখে কোন কথা নেই। পল্লবী আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কি যেন বলতে চাচ্ছে? কিন্তু পারছে না। কেবিন থেকে আমার শার্ট দিয়ে বললেন- আপনার গায়ের শার্ট টা একটু ময়লা হয়ে গেছে। এই টা পরে নেন। প্লিজ, আপনি চলে যান। আপনার তো চাকরি, যেতেই হবে, তাই না? পরে না হয়, সময় হলে আবার আসবেন!
– কিছুই বলতে পারলাম না। বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। দাইমার দিকে কয়েকবার তাকিয়ে মাফ চেয়ে বিদায় নিলাম। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। হসপিটাল থেকে বের হয়ে রিক্সায় উঠলাম। পল্লবী গেইটে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার বাক ঘুরতেই রিক্সার হুট তুলে পিছনে তাকালাম। পল্লবী এখনও চেয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই কান্না করতে করতে ভিতরে চলে গেল। বাস স্ট্যান্ডে এসে ভাড়া দেওয়ার জন্য শার্টের পকেটে হাত দিতেই দেখলাম -একটা চিরকুট।

লেখক – প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *