মালেক ইকবাল।।
আমি তার সামনে বসা অথবা তিনি আমার সামনে বসা, দুটোই ঠিক। তার পিছনে আবার একজন বসা। মুখোমুখি দুটি বসার জায়গা এয়ারপোর্ট করিডরে। নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য আমার দিকে মাঝে মাঝে তাকান। এখানে আমাকে নিয়ে তার ভাবার কোন কারণ নেই। তিনি বিরক্তির সাথে মহাযুদ্ধে লিপ্ত। তার সাথে একটা পার্স আর দুইটা ব্যাগ। মাঝে মাঝে পার্সে কি যেন খুঁজছেন আর ডান পা দিয়ে বড় লাগেজের চাকাটা ঘুরাচ্ছেন। মুখে চুইংগাম চিবানোর মিছিল। কয়েকটা চুল বারবার ঠোঁটের কিনারে দোল খাচ্ছে। ডান হাত দিয়ে সেইগুলো কানের পাশ দিয়ে রাখছেন। আবার চুলগুলো আসছে। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। মনে মনে ভাবলাম- এই চুলগুলো ছোট করার কি দরকার ছিলো? এখন এই ঝামেলা সহ্য করতে হচ্ছে। আসলে এটা ঝামেলা না। ছেলেদের সামনে এমন করাটা মেয়েদের একটা অভ্যাস। যাহোক, সবকিছু ছাপিয়ে তার দৃষ্টি বিমানবন্দরের করিডরে লাগানো বড় স্কিনের দিকে। এরই মাঝে আমাকে দুই বার জিজ্ঞেস করলেন- স্পাইসি জেট-৯৫৭ ফ্লাইট টা কখন? আমি না সূচক উত্তর দিয়ে বললাম -আমিও আপনার মতই।

হঠাৎ স্কিনে ভেসে উঠলো “৯৫৭ ফ্লাইটের পাইলটের করোনা পজিটিভ হওয়ায় ফ্লাইটটি ৪ ঘন্টা পরে যাত্রা শুরু করবে” এরপর আমি চোখের ইশারায় স্কিনের দিকে তাকাতে বললাম। দেখে তো উনি অবাক। এটা কি হলো? আমি কিন্তু খুব একটা অবাক হই নাই। আমার নিজস্ব দায়িত্ব ছিল। তবুও মাঝে মাঝে তার দিকে চেয়ে ছিলাম। তাকে দেখে মনে হল সুন্দরই স্বাভাবিক, স্বাভাবিকই সুন্দর। তাকে দেখার পর থেকে আমি আর মুম্বাই Sahara International Airport এর দিকে তাকাই নি। না মিথ্যা বললাম, তাকাতে পারি নাই, তার কারণে । সে দার্জিলিং এর মত, সুন্দরী নয় সুন্দর। একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম – আপনি কোথায় যাবেন? অপ্রস্তুত হয়ে মাথা নাড়িয়ে বললেন, জী, হ্যাঁ, মরিশাস। লাউ গাছের ডগার মতো মাথা নত করে বললেন- প্লিজ আমার ইমিগ্রেশন ফর্মটা একটু দেখবেন, ঠিক আছে কি না? এইবার সুযোগ এলো তার সম্পর্কে জানার। ভাবছি অনেক কিছু জিজ্ঞেস করব কিন্তু কিছুই করা হল না। তার পাশে বসতেই পার্সপোর্ট আর ফর্ম দিয়ে বললেন-প্লিজ, একটু চেক করুন, আমি আসছি।

ঘুরে এসে আবার সেই সিটে বসলেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম- এক্সকিউজ মি, আপনার কাছে পাঁচ শ রুপি চেঞ্জ হবে?
– মনে হয়, হবে না। তারপরও দেখছি।
বাম পাশে রাখা পার্স খুলে বললেন- হুম, হবে। কিন্তু একদম খুচরো। লাইক বিশ, পঞ্চাশ একশ এমন। ইচ্ছে করলে নিতে পারেন।
– আপনার মতো হলে চলবে।
– আমার মতো হলে মানে বুঝলাম না!
– মানে, বুঝেন নি। অইতো, আপনার মতো।
এইবার কিছুক্ষণ নিরব। মনে মনে কী যেন ভাবচ্ছেন? হঠাৎ নিচের ঠোঁট টা উপরের দাঁত দিয়ে আলতো করে চাপ দিয়ে মুচকি হাসলেন। দু চোখ তুলে ছোট্ট করে আমার দিকে তাকালেন। আমার চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় দাঁড়িয়ে গেলেন। এরপর বেঞ্চ থেকে নেমে নিজের ভ্যানিটি ব্যাগের পাশে বসলেন। চেইন খুলে একদম নতুন আর চকচকে দুটি একশ রুপি এবং তিনটা পঞ্চাশ রুপির নোট দিয়েই বললেন- এইবার ঠিক আছে না?
– ওয়াও! ঠিক মানে, ১ এর ক।
– ১ এর ক, মানে বুঝলাম না!
– আপনার বুঝতে হবে না। এইবার উপরে উঠে বসুন। আমার সামনের সিটে বসলেন। এরই মাঝে আকাশে মেঘ। দমকা বাতাস। মাথা থেকে ঘোমটা পড়ে যেতেই দু হাত দিয়ে তুললেন। ডান কানের অর্ধেক পর্যন্ত ঘোমটা দিলেন। তার মানে হাফ ঘোমটা। পরিবেশটা আমাকে ঘায়েল করার জন্য যথেষ্ট ছিল। মেঘের ঝিলিক তার ফেসের ওপর পরতেই আমি চমকে উঠলাম। সবকিছুই এপার অপার আর পরিপাটি। এই যুগে এরকম সাধারণ পোশাক পরা মেয়ে বিরল। কয়েক হাজারের মধ্যে সে এক প্রকার। তথাকথিত স্মার্ট নামে আনস্মার্ট থ্রি জানালার পোশাক ছাড়া। আরে এই যুগে কেউ কি এমন ওড়না ব্যবহার করে? না, ও কিন্ত শুধু ওড়না পরেনি সাথে হাফ ঘোমটা, ঠিক হিনা রব্বানির মতো।

আবার যখন আযান শুরু হল তখন ফুল ঘোমটা। আমার পছন্দের ছোট্ট কালো তিলটা ঠিক জায়গায়। মানে ঠোঁটের কোনায়। একবার আমার কাছে কি যেন চাইলেন, আমি শুনতে পেলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বললেন? তিনি বললেন- না, লাগবে না। কিছুক্ষণ আগে তার ফর্মটা দেখেছিলাম, ওই যে চেক করার সময়। কিন্তু এখন নামটা পর্যন্ত মনে করতে পারছি না। নিজের ওপর ভীষণ রাগ হলো। তার ফর্মটি আবার চাইতেই ভয়ে চমকে উঠে বললেন- কেন, কোন ভুল হয়েছে আমার? আমি বললাম- না আমি এমনিতেই দেখছি? এই সুযোগে নাম দেখে নিলাম। দেশ দেখব সেটাও ভুলে গেলাম। তখন নিজেকে ৯৫৭ নম্বর কয়েদি মনে হলো। মনের জেলখানায় নিজেকে বন্দী মনে হচ্ছিল। এরই মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ভয়ে কেপে উঠে জোরে এক নিঃশ্বাস নিলেন। সেটা আমার শার্ট এ অনুভব করলাম। খুব আস্তে করে sorry বললেন। আমি বললাম- না, ঠিক আছে। আর মাত্র ১৯ মিনিট বাঁকি। এটা বলতেই তিনি বললেন – আমি যাবো না, টিকিট ক্যান্সেল করেছি, বাই।

কিছুটা না, অনেকটা কষ্ট পেলাম। আমি সেই ১৯ মিনিট পার করলাম। হঠাৎ ঘোষণা আসলো ৯৫৭ নম্বর ফ্লাইট অনিবার্য কারণবশত বাতিল। কি আর করা? মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। চারিদিকে টিপটিপ বৃষ্টি। মাঝে মঝে আলোর ঝলকানি। সাথে মেঘের গর্জন। এরই মধ্যে ছাতা নিয়ে মুম্বাই বিমানবন্দরের ৬ নম্বর গেটের সামনে দিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ পেছন থেকে একজনের কণ্ঠস্বর আমার কানে আসলো। একটু খেয়াল করে দেখি “সে”। আমি তো অবাক, এটা কিভাবে সম্ভব? আমি বললাম- জি বলুন।
-আমরা যেখানে ছিলাম, ওখানে আমি একটা ব্যাগ রেখেছিলাম। আমি গিয়ে দেখলাম রুমটা এখন বন্ধ। প্লিজ একটু হেল্প করবেন কি?
আমি মনের ওজান্তেই বলে ফেললাম- সিউর, চলুন কন্ট্রোল রুমে গিয়ে দেখি। কিন্তু এখন ত বৃষ্টি হচ্ছে, কিভাবে যাবেন?
-আপনার ছাতা আছে না?
– ছাতা তো একটা!
-প্রবলেম নেই, দুজন এক ছাতার নিচে যেতে পারব।
আমি মনে মনে ভাবলাম, ক্যামনে কি হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছি না? কিছুক্ষণ আগে যার জন্য খুব! সে এখন আমার ছাতার নিচে। আমি ইচ্ছে করলে সরাসরি কন্ট্রোল রুমে নিতে পারতাম, কিন্তু ৪, ৮, ৫, ৭ নম্বর গেট ঘুরিয়ে তারপর নিয়ে গেলাম ১ নম্বর গেটে।

১ নম্বর গেটে গিয়ে জানতে পারলাম, ওই গেটের চাবি টা ৬ নম্বর গেটে। তারপর তাকে নিয়ে ৭ নম্বর ফ্লর দিয়ে একটু নির্জনে দুজন আসলাম। কথা হচ্ছে কিন্তু আমি একাই শুনতে পাচ্ছি। এতো আস্তে কেউ কথা বলে আমি এই প্রথম শুনলাম। মনে হল আরও কিছু বলুক আরও কিছু শুনি।এরপর চলে আসলাম আবার ৬ নম্বর গেইটে। এসে জানতে পারলাম ওই অফিসের চাবি এখনও জমা দেয়নি। আবার চলে আসলাম ওই জায়গায় যেখানে দুজন ৩ ঘন্টা ৪১ মিনিট ছিলাম। গিয়ে দেখি অফিস খোলা। আমার চোখের তাকিয়ে কান্নার স্বরে ৪/৫ বার sorry বলে বললেন-প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি দূর থেকে দেখেছিলাম। ভাবছিলাম হয়তো বন্ধ, সেই জন্য এই রুমে আসিনি। প্লিজ আমাকে মাফ করবেন। আপনি আমার জন্য অনেক কষ্ট করলেন, প্লিজ মাফ করবেন।
-আরে না, ঠিক আছে, এটা তেমন কিছু না। আগে চলুন ব্যাগ নিয়ে আসি। আশেপাশে তেমন কেউ নেই করোনা আতংকে। আমি আর শুধু ও। দুজন’ ই রুমে ঢুকলাম। দেখি ব্যাগ নেই। দুজনের’ই মাথায় হাত। আমি বললাম, আপনি যে এতো বার Sorry বললেন, তাতে লাভ কি হলো? এখন যে আপনার কাছে আমাকে মাফ চাইতে হবে।
-না, আপনি আমার জন্য অনেক করলেন। প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আমি কিন্তু ইচ্ছে করে এসব করিনি। প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না।
-সব ঠিক আছে, কিন্তু আপনার ব্যাগ?
-থাক, আমার ব্যাগ লাগবে না।

এরই মাঝে এক পুলিশ এসে বললেন, এই যে ম্যাম, এটা কি আপনার ব্যাগ? জ্বি বলে পুলিশের হাত থেকে ব্যাগটা নিলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে সাত দিনের শিশুর মতো মুচকি হেসে কী যেন বললেন? আমি বুঝতে পারি নাই, ওই যে আস্তে আস্তে ছোট্ট করে কথা বলে। হঠাৎ উনি অনেকটা দূরে চলে গেলেন। মাঝখানে পুলিশ। ইশারায় আমি পুলিশকে তার ফোন নম্বর জিজ্ঞেস করতে বললাম। পুলিশ উচ্চস্বরে শব্দ করে উনাকে বললেন, এক্সকিউজ মি, উনি আপনার ফোন নম্বর জানতে চায়। উত্তরে বললেন, প্লিজ, উনাকে বলে দেন, আমি তাকে মেসেঞ্জারে নক দিবো।

লেখক- প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *