মালেক ইকবাল।।
কিছুদিন আগে পৃথিবী ছিল করোনাময় আর এখন ভ্যাক্সিনময়। এই বিষয়টা বর্তমানে প্রায় বিপদ মুক্তির উৎসবে পরিণত হয়েছে। ভ্যাক্সিন নিলেই ফেসবুকে পোস্ট দিতে হবে। না হলে মনে হয় ভ্যাক্সিন কাজ করবে না। আমিও ট্রেন্ডের বাহিরে নয়। রেজিষ্ট্রেশন শেষে তিন দিন পর লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। বেশ লম্বা লাইন। আমার সিরিয়াল নম্বর ১৯। অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। গরমও লাইনে তার জায়গা দখল করে নিছে। একটু অস্বস্তিকর পরিবেশ। আর কত সময় লাইনে থাকতে হবে কে জানে? বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক আর অপ্রাসঙ্গিক আলোচনায় সবাই মত্ত। আমি চুপচাপ। এরকম পাবলিক প্লেসে কথা একটু কম বলার চেষ্টা করি। আবার ফ্লোর পেলে বিষয়টা অন্যরকম হয়ে যায়। মাথায় বিভিন্ন চিন্তা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ একজন আমার নাম ধরে ডাকলেন। অবাক হলেও হাফ ছেড়ে বাচলাম।

হসপিটাল করিডরের চেয়ারে বসতে বলে ছেলেটা কোথায় চলে গেলো খেয়াল করতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পরে একজন নার্স এসে আমার সব তথ্য আমাকেই বলে জিজ্ঞেস করলেন- সব ঠিক আছে তো? মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক বাক্য বলে জিজ্ঞেস করলাম-আচ্ছা, কেন বলুন তো? কোন সমস্যা না সুবিধা?
– আমি কিভাবে বলি? প্লিজ, আপনি ১১৯ নম্বর রুমে গিয়ে বসুন।
কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলাম। সবাই ভ্যাক্সিন নিচ্ছেন ১০৭ নম্বর রুমে। আর আমাকে যেতে বলছে অন্য রুমে। কাহিনী কি? কিছুই বুঝতে পারছি না। করিডোর দিয়ে হাটতে শুরু করলাম।

পাশ দিয়ে অনেক মুমূর্ষু রোগীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছিমছাম পরিবেশ। মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। এক নিমিষেই মৃত্যুর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। রুম নম্বর গুলো একটু এলোমেলো মনে হলো। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম – এক্সকিউজ মি, ১১৯ নম্বর রুমটা কোন দিকে?
উত্তরে বললেন- সামনে গিয়ে, হাতের ডান পাশের একদম কর্ণারের রুমটা।

রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কোথাও কেউ নেই। একদম ফাঁকা। মনে হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। আসলাম ভ্যাক্সিন নিতে। আবার কি হয়, কে জানে! ভয়ে ভয়ে তিন থেকে সাড়ে চার বার দরজা নক করলাম। সাড়ে চার বার মানে চার বার জোরে আর একবার একটু আস্তে নক করলাম। ভিতর থেকে কোন উত্তর পাচ্ছি না। হঠাৎ পেছন থেকে একজন বললেন- আপনি ভিতরে গিয়ে ১২/১৫ মিনিট বসুন। উনার কথার কোন উত্তর না দিয়েই ভিতরে গিয়ে বসলাম। নিজেকে সামলাতে একটু সময় নিলাম। রুমটা একদম পরিপাটি। মনে হচ্ছে কেউ যেন নিজের মনের মাধুরি মিশিয়ে সাজিয়েছেন। সামনে দুইটা সিম্পল চেয়ার আর ডক্টরের হুইল চেয়ারটা বেশ সুন্দর। টেবিলের ওপরে একটা ল্যাপটপ, প্রেসক্রিপশন প্যাড, ফ্লাওয়ার ভেস এবং এক বোতল কিনলে পানি। পাশেই ফোর স্ক্রটেড পেশেন্ট বেড। দেওয়াল আর ফ্লোরের টাইলস একদম সাদা। দেওয়ালের সাথে মাঝারি সাইজের টিভি স্কিন। এতে “দ্যা গড মাস্ট বি ক্রেজি” সিনেমা চলছে। ঠিক অপজিট দেওয়ালে টাঙানো আছে হাতে করা কয়েকটা পেইন্টিং। রুমের বাম দিকে ছোট্ট একটা বেলকুনি। তার পাশেই সাদা গোলাপ ফুলের বাগান। মাঝে মাঝে আবার লাল গোলাপ। কিছুটা হারিয়ে গেলাম।

হঠাৎ রুমে একজন প্রবেশ করলেন। আমি দাড়িয়ে গেলাম। উনিও না বসে তার চেয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। দুজন মুখোমুখি। কোন কথা নেই। অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমিও চোখ ফেরাতে পারছি না। লাস্ট কবে দেখেছি মনে পরছে না। চোখের পোলক নামিয়ে টেবিলের ওপর দু হাত রেখে নিচের দিকে চেয়ে আছেন। ডান হাতে ঝিনুকের ব্যাস্লাইট। অভ্যাসটা চেঞ্জ করতে পারে নি। আমি চোখের পলক সড়াতে পারছি না। খেয়াল করে দেখলাম তার মনের মধ্যে অজস্র প্রশ্ন। রাগ আর অভিমানে নিজের খেই হারিয়ে ফেলছে। একটুও চেঞ্জ হয়নি। একদম আগের মতোই আছে। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে আছে। বিমর্ষ লাগছে। সামনে একটা বই তার উপর সবুজ রঙের কলম। পাশেই সাদা রঙের চায়ের কাপ আর কালো ফ্রেমের চশমা।

গায়ে ডক্টরের সাদা এপ্রোন তার নিচেও হোয়াইট কালারের শার্ট। দেখে মনে হচ্ছে সেই কলেজ ড্রেসটা পড়ে আছে। রেগুলার পোশাকের চেয়ে কলেজ ড্রেস্টাই আমার বেশি পছন্দের ছিল। এইজন্য মাঝেমাঝে কলেজ প্রোগ্রামে দুইটা ড্রেস নিয়ে আসতো। একটা তার পছন্দের আর আমার পছন্দের কলেজ ড্রেসটা। সিধি করা সিল্কি আর ঝলমলে চুল পিছনে আছড়ে পরছে। মাথার বাম পাশের কয়েকটা চুল মাঝেমাঝে ঠোঁটের কিনারে খাবি খাচ্ছে। আগে চুল অনেক বড় ছিল। হয়তো কোন কারণে ছোট করেছে। তবে এখনও Joico shampoo মাখে। সেই পরিচিত ফ্লেভার এই রুমেও পাচ্ছি। নাকে কোন অলংকার নেই। অই যে ছোট বেলায় ভয় করে নাক ফোড়ায় নি, তাই। এখনো নিচের দিকে চেয়ে আছে। জানালার স্কিন ভেদ করে আসা সূর্যের কিরণ তার চুলের সিধির সাদা স্কিনের ওপর প্রতিফলিত হয়ে আমার চোখে লাগছে। কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না!

হঠাৎ নিরাবতা ভেঙে প্রশ্ন করলেন – আমার ওপরাধ ছিলো কী? একদম চুপচাপ রইলাম। কি বলবো? কিছুই বলার নাই। কারন প্রশ্ন কমন কিন্তু উত্তর তো জানা নাই। অভিমানের বুদবুদি নিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে বসতে বললেন। বসলাম। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। উত্তরে বললেন- কেন?
– এই যে বসতে বললেন।
– আমাকে আপনি করে বলছেন কেন?
– সময়ের ব্যবধান তুমিকেও আপনি করে দেয়।
আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। হাতটা টেবিলের ওপর রাখতেই জিজ্ঞেস করলেন- আঙ্গুলে ব্যান্ডেজ কেন? কি হয়েছে?
– তেমন কিছু না। পানি গরম করতে গিয়ে গরম পানি লেগে তিনটা আঙ্গুলে ফস্কা উঠছে। একটু মনটা খারাপ করে বললো – কেন? প্রথমা রান্না করে না?
হতবম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কোন প্রথমা?
– কেন? প্রথমার পরেও কি আবার প্রথমা আসছে নাকি?
– এখনও মনে আছে তার কথা!
– কেন মনে থাকবে না! যার কারণে এত্ত কিছু। তারপরও মনে থাকবে না। প্রথমা কেমন আছে?
– জানি না।
একদম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন- মানে কি? এটা কি বলছেন? এটাও সম্ভব!
– গত ২ বছরে আগে ইতালি থেকে একটা ফোন আসছিলো। শুধু আমাকে বললেন- আগামীকাল আমার সিজার, মেয়ে শিশু হবে। দোয়া করবেন। এই বলে ফোনটা কেটে দেয়। এখনও বুঝতে পারি নাই, ওটা কার কন্ঠ ছিল। ভয়েচটা ক্লিয়ার ছিল না। বারবার ইচ্ছে সত্ত্বেও ফোন আর ব্যক করা হয় নি।

এসব শোনার পর চেয়ার থেকে উঠে আমার সামনে দাঁড়ালেন। চোখ দিয়ে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছেন। চোখ দুটো ছলছল করছে। কি মায়াবী চাহনি! আমার ডান হাতটা তুলে টেবিলের ওপর রাখলেন। গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন দেখছেন? কি মনে করে বলেই ফেললেন-প্লিজ, আপনি এখান থেকে চলে যান। আমিও কিছু না বলে চলে আসতে লাগলাম। হঠাৎ বাম হাতটা আলতো করে ধরে চোখের দিকে চেয়ে বললেন- সত্যিই, চলে যেতে পারবেন! কোন উত্তর না দিয়ে বললাম- একটা রিকুয়েষ্ট করবো, রাখবেন?
– কেন, রাখবো না?
– আপনার গালের স্কিনের নিচের হাল্কা নীলচে রগটা দেখতে চাই।
– আরে আজিব, এটা কি আগের মতো দেখা যায় নাকি? এখন বড় হইছি না?
– ঠিক আছে, আমি দেখছি। আপনি শুধু চেয়ারে গিয়ে বসুন। কোন কথা বলা যাবে না কিন্তু।

কথামতো ভদ্র মেয়ের বেশে চেয়ারে গিয়ে বসলেন। আমি বাম হাত দিয়ে বেলকুনির পাশের জানালার স্কিন টেনে দিলাম। এক সাইডে একটু ফাকা রাখলাম। সেখান দিয়ে সূর্যের আলো তার চুলের ওপর কিরণ দিচ্ছে। না, হলো না। চেয়ারটা আরেকটু উঁচু করলে ঠিক গালের উপর আলোটা পড়বে। তখন তার পাশে গিয়ে হুইল চেয়ারটা বাম হাত দিয়ে ঘুড়াতে শুরু করলাম। চেয়ারটাও এমনভাবে উঁচু করলাম যেন ঠিক গালের উপর আলো পড়ে। এরপর সামনের চেয়ারে বসে তার দিকে চেয়ে রইলাম। কী সুন্দর অদ্ভুত মায়াবী লাগছে দেখতে। মনে হচ্ছে সূর্যের সম্পূর্ণ রক্তিম আভা তার গালের উপর প্রতিফলিত হচ্ছে। আর স্কিনের নিচের হাল্কা নীলচে রগটা একদম স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার চোখের তাকিয়ে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। চোখে পানি টলমল করছে। হঠাৎ দেখি গাল বেয়ে অশ্রু নীলচে রগটার উপর দিয়ে ঝড়ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে টিস্যু দিয়ে চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করছেন। কান্না ভেজা কন্ঠে কাপাকাপা স্বরে বললেন- না, আমার কিছু হয় নি। আমি ভালো আছি। প্লিজ, আপনি ভ্যাক্সিন নিয়ে চলে যান।

কিছুটা স্বভাবিক হয়ে ভ্যাক্সিন নিয়ে আমার পাশের চেয়ারে বসলেন। ভ্যাক্সিন সিরিঞ্জে ভরে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- এখনো এইসব ড্রেস ব্যবহার করেন। বাদ দিতে পারেন নি, না? সেই জামার নিচে টি শার্ট। আবার শার্টের বোতাম খোলা। আমি কিছুই বললাম না। শার্টের হাতার বোতাম খুলতে চেষ্টা করলাম, পারলাম না। এটা দেখে হাত থেকে সিরিঞ্জ রাখলেন। আমার ব্যন্ডেজ করা হাত টেবিলের ওপর রেখে বললেন- প্লিজ, কষ্ট করে হাতটা একটু উঁচু করে ধরুন। তারপর শার্টের হাতার বোতাম খুলে বাম দিকে ঘুরলেন। হঠাৎ তার কয়েকটা চুল আমার চোখে লাগতেই আমি দাড়িয়ে গেলাম। বাম হাত দিয়ে চোখের পাতা ধরে রাখছি। হাত দিয়ে আমার হাতটা আলতো করে সড়িয়ে বললেন- সরি, আমি খেয়াল করি নাই। প্লিজ, একটু ঘুরুন, শার্ট সম্পূর্ণ খুলে ফেলতে হবে কারণ নিচে আবার টি শার্ট আছে। তারপর শার্ট টা খুলে টেবিলের ওপর রাখলেন। আমার টি শার্টের হাতা ভাজ করে ওপরের দিকে তুলছেন। কিছু না বলে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছি। আবেগী না হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। এরপর মেডিসিন আর তুলা নিয়ে আমার কাধের নিচে মালিশ করছে। অবাক হয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন- এই, আপনার ডান কাধে তিল আছে? উত্তরে বললাম- হুম, কেন বলুন তো? এক চিলতে হাসি দিয়ে বললেন- ডান কাধে তিল ওয়ালা মানুষ নাকি খুবই ভাল মনের অধিকারী হয়! এই সময়ে হঠাৎ দরজায় নক। একজন নার্স এসে দরজা খুলে বললেন – ম্যাম, ডিরেক্টর স্যার এখনি আপনাকে একটু দেখা করতে বলেছেন।

লেখক- প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *